বিএনপির কর্মসূচির কৌশলে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ

কখনো লাখো মানুষ, কখনো বড় কর্মূসচি দিয়ে জোরালো অবস্থান না নেয়া। এক কদম এগোনো তো, দুই কদম পেছানো। সরকার পতনের আন্দোলনে কী ছকে এগোচ্ছে বিএনপি? অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বা কর্মসূচি পরিপালনে কার পরামর্শে চলছে দলটি? এসব বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেকটাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কখনো লাখো মানুষ, কখনো বড় কর্মূসচি দিয়ে জোরালো অবস্থান না নেয়া। এক কদম এগোনো তো, দুই কদম পেছানো। সরকার পতনের আন্দোলনে কী ছকে এগোচ্ছে বিএনপি? অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বা কর্মসূচি পরিপালনে কার পরামর্শে চলছে দলটি? এসব বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেকটাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচিসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। অন্যদিকে বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি আসছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। 

সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ দেশের সব জেলা ও মহানগরে সমাবেশ করবে বিএনপি। ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলে এ প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেয় দলটি। একই দিন সারা দেশে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি ডেকেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যদিও রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের মেলার মাঠে এদিন দলটি শান্তি সমাবেশ ডেকেছিল। গতকাল তা বাতিল করে নতুন কর্মসূচি দেয়। 

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গত ডিসেম্বর থেকেই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ঢাকাসহ সারা দেশে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে আসছে। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে থাকা বিএনপি ২৭ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেয়। এর পাল্টা হিসেবে একই দিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম—যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। কিন্তু বৃহস্পতিবার কর্মদিবস হওয়ায় পুলিশ কোনো দলকেই অনুমতি দিচ্ছিল না। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাদের কর্মসূচি একদিন পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়। যুবলীগও তখন জানায়, তাদের তিন সংগঠনের শান্তি সমাবেশ একদিন পিছিয়ে ২৮ জুলাই বেলা ৩টায় অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ১২ জুলাই নয়াপল্টনে বিএনপি এবং বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ সমাবেশ করে। 

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে এটা তাদের বড় সফলতা। এ মুহূর্তে তারা খুব সতর্কতার সঙ্গেই কর্মসূচি নির্ধারণ করছে। তারা আর হয়তো কোনো ধরনের ভুল করতে চায় না। এজন্য টানা কর্মসূচিও অব্যাহত রেখেছে। বিএনপির এ রাজনৈতিক কৌশলে অনেকটাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ক্ষমতাসীনরা। সে কারণেই বিরোধীদের কর্মসূচি ঘোষণার পর পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বলতে নারাজ ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপির কর্মসূচি থেকে সংঘাত, সরকার হটানো, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। এগুলো দেশের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলার পরিপন্থী। তাই আওয়ামী লীগের কর্মসূচি থেকে শান্তির বার্তা দেয়া হচ্ছে, তুলে ধরা হচ্ছে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে। মূলত বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করছে আওয়ামী লীগ। 

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করছি। তবে তাদের কর্মকাণ্ড যখন আইন-শৃঙ্খলার পরিপন্থী হবে তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। কখনো সমাবেশ, কখনো মহাসমাবেশ আবার কখনো বাগযুদ্ধ; এটা হতেই পারে। তবে তাদের যে সমাবেশ সেটা সংঘাতের সমাবেশ। আর আমাদের সমাবেশ শান্তির সমাবেশ। কারণ সমাবেশে কত মানুষ হয়েছে বা কে কে আসছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেখান থেকে কী কী কথা উচ্চারিত হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’ 

রাজধানীর নয়াপল্টনে গত শুক্রবার মহাসমাবেশ করে বিএনপি। সেখান থেকে শনিবার রাজধানীর প্রবেশপথগুলোয় অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয় দলটি। আওয়ামী লীগের দুই সহযোগী এবং এক ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনও শুক্রবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করে বিএনপির পাল্টা কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে শনিবার সকাল থেকেই প্রায় সব পয়েন্টেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মহড়ার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়। গাবতলী, সাইনবোর্ড, পুরনো ঢাকার নয়াবাজার ও ধোলাইখাল এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের একটি গাড়িসহ আরো কয়েকটি বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। 

উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিন বিকালে সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের জরুরি যৌথসভা ডাকা হয়। সভা শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ রোববার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একই দিন বিএনপির পক্ষ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সোমবার সারা দেশে সমাবেশের ঘোষণা দেন। ওইদিন রাতেই ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আজ (সোমবার) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের মেলার মাঠে শান্তি সমাবেশের ঘোষণা আসে। তবে একদিন আগে গতকাল ওই কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। 

বিএনপির কর্মসূচি প্রসঙ্গে ফারুক খান বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে কোনো দল যদি কর্মসূচি দেয়, সেখানে যদি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়, কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম না করা হয় তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরাও তো আমাদের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু গত শনিবার তারা (বিএনপি) যেটা করেছে সেটা তো সহ্য করা হবে না। তাদের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের জন্যই পুলিশ অ্যাকশন নিয়েছে। আগামীতেও দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দেশের জনগণকে কষ্ট দিয়ে, ভাংচুরের মতো কোনো কর্মকাণ্ড বিএনপিকে করতে দেয়া হবে না। তাদের যেমন সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে, তেমনি প্রত্যেকটা মানুষেরও শান্তিতে থাকার অধিকার রয়েছে।’ 

বিএনপির সমাবেশকে সংঘাতের সমাবেশ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এ নেতা আরো বলেন, ‘বিএনপির কথা হচ্ছে সংঘাতের কথা। তাদের কথা—নির্বাচন করব না, হতেও দেব না। এগুলো অগণতান্ত্রিক কথা। তাদের কথা এ সরকারকে ১ সেকেন্ডও থাকতে দেয়া হবে না, সরকারকে টেনে নামানো হবে, এ সরকার পালাবার রাস্তা পাবে না—এ কথাগুলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা না। সুতরাং বিএনপির সমাবেশ সংঘাতের সমাবেশ, আমাদের সমাবেশ শান্তির সমাবেশ। আপনারা (বিএনপি) শান্তিপূর্ণভাবে থাকেন, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং আপনাদের মূল্যবান ভোটের অধিকার প্রয়োগ করেন। আপনারা মানুষকে বলুন যে আপনারা কী কী কাজ করেছেন, আগামীতে এই এই কাজ করব। তাছাড়া বিএনপির এতদিনে বোঝা উচিত তারা অতীতে বিশেষ করে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তাতে তাদের কোনো লাভ হয়নি। সংঘাত করে, পেছনের দরজা দিয়ে, বিদেশী প্রভুদের পদলেহন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসতে পারবে না। এটা তাদের বুঝতে হবে। এটা তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে সেটা তাদের জন্য ভালো, দেশের জন্য ভালো এবং গণতন্ত্রের জন্য ভালো।’

ঢাকার গোলাপবাগে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে ১০ দফার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। এসব দাবির মধ্যে ছিল বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, ১৯৯৬ সালের সংবিধান সংশোধনের আলোকে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর সাজা বাতিল। এরপর গত ২৩ মার্চ বিএনপিকে নির্বাচন কমিশন সংলাপের আমন্ত্রণ জানালেও সেটি প্রত্যাখ্যান করে দলটি। তারা মনে করে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা অথবা সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না এবং তা হবে অর্থহীন।’ এ দাবিতে অনড় থেকে সাম্প্রতিক সংসদীয় উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় অংশ নেয়নি তারা। 

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট যে দলীয় সরকারের অধীনে কখনই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি, জনগণ ভোট দিতে পারেনি এবং এবারো যে পারবে তারও কোনো কারণ নেই। এখন আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল। তাদের জনসমর্থন নিয়ে প্রশ্ন আছে, তাদের (সরকারের) বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে সেটা নিয়ে তো অনেক রকম প্রশ্ন। শুধু তা-ই নয়, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়েও প্রশ্ন। এসব কারণে তারা খুব দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।  এখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মাধ্যমে যদি কোনো রকম কিছু হয়, তখন তাদের জন্য সুবিধা। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা বিরোধী দলকে ভয় দেখিয়ে, চাপে রেখে একটা নির্বাচন করতে চায়।’

আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বলছেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তা প্রতিহত করতে মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে দলটির আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেকদিন পর বিএনপি আগের চেহারায় ফিরে এসেছে। তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের নামে যদি কিছু অর্জন করেও থাকে, সেগুলোও তাদের ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তারা যদি জনগণের কিছু সহমর্মিতা পেয়েও থাকে বা কিছুটা বিশ্বাসও যদি অর্জন করে থাকে, গত শনিবারের একদিনের কর্মসূচিতে তাদের ইমেজ শেষ হয়ে গেছে। এখন তাদের কর্মসূচিতে কোনো বৈচিত্র্য নেই, যা হচ্ছে সবই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।’

আরও