মালদ্বীপে শ্রম রফতানির তথ্যে ঘাটতি, প্রবাসীদের বেশির ভাগ অর্থ আসছে হুন্ডি-হাওলায়

বড় হচ্ছে মালদ্বীপে বাংলাদেশী শ্রমবাজারের আকার। যদিও দেশটিতে শ্রমিক রফতানিসংক্রান্ত তথ্যে এখনো রয়ে গেছে বড় ধরনের ঘাটতি। সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার পরিসংখ্যানেই দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশীর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। জনশক্তি রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশী অভিবাসীদের বেশির ভাগকেই এখনো নথিভুক্ত করা যায়নি। নথিভুক্তি না হওয়ায় এসব অভিবাসীর দেশে পাঠানো অর্থও বৈধ চ্যানেলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বরং দেশটি থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থে এখন হুন্ডি-হাওলার আধিপত্যই দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

বড় হচ্ছে মালদ্বীপে বাংলাদেশী শ্রমবাজারের আকার। যদিও দেশটিতে শ্রমিক রফতানিসংক্রান্ত তথ্যে এখনো রয়ে গেছে বড় ধরনের ঘাটতি। সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার পরিসংখ্যানেই দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশীর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। জনশক্তি রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশী অভিবাসীদের বেশির ভাগকেই এখনো নথিভুক্ত করা যায়নি। নথিভুক্তি না হওয়ায় এসব অভিবাসীর দেশে পাঠানো অর্থও বৈধ চ্যানেলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বরং দেশটি থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থে এখন হুন্ডি-হাওলার আধিপত্যই দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। 

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অনথিভুক্ত প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সরকারের দায়ভার নেয়ার সুযোগ কম। আবার এ ধরনের প্রবাসীদেরও গন্তব্য দেশে নানা নিগ্রহের শিকার হতে হয়। নানা ধরনের আইনি ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। কাজ করতে হয় ন্যূনতম মজুরিতে। অনেক সময় শ্রমদাসও বানিয়ে রাখা হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনেরও সম্মুখীন হতে হয়। নথিভুক্ত না হলে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। 

নথিভুক্ত না হওয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের অধিকাংশই মালদ্বীপে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না বলে দেশটি থেকে ফিরে আসা প্রবাসীরা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে না পারায় তাদের হয় হুন্ডি-হাওলায় অর্থ পাঠাতে হয়, নয়তো অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হয়। হুন্ডিতে পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যায়। সেজন্য অন্য কারো অ্যাকাউন্টে না পাঠিয়ে এখানকার শ্রমিকরা হুন্ডি-হাওলার ওপরই ভরসা করেন বেশি। 

মালদ্বীপফেরত অভিবাসী মোহাম্মদ রাজীব বলেন, ‘মালদ্বীপে শ্রমিকরা নথিভুক্ত না হওয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। কোনো কর্মীর মৃত্যু হলেও তাকে দেশে আনা কঠিন হয়ে যায়। কোম্পানিগুলো মৃত ব্যক্তির দায়িত্ব নিতে চায় না। কারণ মৃতদেহ পাঠাতে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারেরও সাহায্য পাওয়া যায় না। আমরা যারা ছিলাম তারা চাঁদা তুলে মৃতদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করতাম।’ 

নথিবহির্ভূত অভিবাসনকে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের বঞ্চনার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী বলেন, ‘মালদ্বীপ আনডকুমেন্টেড শ্রম রফতানিকে উৎসাহ করে। এটা তাদের রাষ্ট্রীয় পলিসি। আনডকুমেন্টেড থাকলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের তারা কম মূল্যে কিনতে পারে, যার কারণে এ ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতির কারণেই অবৈধভাবে শ্রমিক আমদানি করতে চায় তারা। এক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা ও নিগ্রহের শিকার হয়।’ 

মালদ্বীপে শ্রমিকদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। যদিও ২০২১ সালে দেশটিতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত এক লাখের বেশি অভিবাসী আছেন বলে জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশী এখন অনিয়মিত অবস্থায় মালদ্বীপে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বর্তমানে তাদের নিবন্ধনের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে দূতাবাস। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মালদ্বীপের জনসংখ্যা ৩ লাখ ৪১ হাজার ৩৫৬ জন। আর সেখানে বাংলাদেশী অভিবাসী আছে দেড় লাখেরও বেশি। এখানে অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশীই সবচেয়ে বেশি। এ কারণে মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি বন্ধ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে মালদ্বীপের ভিসা বন্ধ। গত কয়েক বছরে মালদ্বীপে ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে সেখানে কাজ করছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেউ ট্যুরিস্ট ভিসায় ঘুরতে গিয়ে সেখানে থেকে গেলে তার হিসাব তো সরকার করতে পারবে না।’ 

মালদ্বীপের অভিবাসীদের নিয়ে ‘মাইগ্রেশন ডাইনামিকস অব বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য মালদ্বীপ করিডোর’ শিরোনামে সম্প্রতি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক গবেষণা চালায়। ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রত্যেক অভিবাসী গড়ে রেমিট্যান্স পাঠায় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৬৭ টাকা। সে হিসাবে বছরে মোট ২ হাজার ৯৭৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স মালদ্বীপ থেকে আসার কথা। তবে এ অর্থের ৬৬ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে ৪১ শতাংশ। 

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক সিআর আবরার বলেন, ‘৭৬ সালের পর থেকে ফরমাল চ্যানেলে বিভিন্ন দেশে আমাদের কতজন অভিবাসী গেছেন তার তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু ইনফরমাল চ্যানেলে কতজন অভিবাসী গেছেন তার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কূটনৈতিক কারণে ইনফরমাল চ্যানেল সম্পর্কে মন্তব্য করা সরকারের জন্য কঠিন হলেও এদের একটা হিসাব রাখা দরকার। ইনফরমাল চ্যানেলে কতজন যাচ্ছেন, তাদের মাত্রা কত, তারা কোন ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত তার হিসাব সরকারের রাখা দরকার।’ 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌মন্ত্রণালয়ের তথা বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স কার্ড নিয়ে যারা মালদ্বীপ গেছেন তাদের হিসাব সংরক্ষিত আছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা মালদ্বীপ গিয়ে কর্মে যুক্ত হয়েছেন, তারাই মূলত অনিয়মিত হচ্ছেন। এছাড়া বৈধভাবে গিয়ে যারা বিভিন্নভাবে জেনে বা না জেনে বেআইনি কাজে যুক্ত হন, যেমন যারা বিনা অনুমতিতে চাকরি পরিবর্তন বা কর্মস্থল থেকে পালিয়ে অন্যত্র কাজ করছেন, তারাও অনিয়মিত হয়ে পড়েন। এ ধরনের সমস্যা গন্তব্য দেশে বাংলাদেশের কর্মীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয় এবং তার প্রভাব পড়ে গন্তব্য দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ওপর। আর যেকোনো গন্তব্য দেশে অবৈধ বা অনিয়মিত কর্মীদের তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন বৈধপথে দেশে পাঠানো বেশি চ্যালেঞ্জিং। আমরা বিদেশ যাওয়ার আগে কর্মীদের বাধ্যতামূলক প্রি-ডিপারচার ওরিয়েন্টেশনে এসব বিষয়ে সচেতন করি। কর্মী ও রিক্রুটিং এজেন্সির অধিকতর দায়িত্বশীল আচরণ আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের কর্মীদের চাহিদা বৃদ্ধি করবে। কর্মীরা নিজেরাও উপকৃত হবেন।’

আরও