ঈদে নড়াইলে ৩ কোটি টাকার কামারশালার পণ্য বিক্রির আশা

নড়াইলের কামারদের তৈরি জিনিসপত্রের সুনাম রয়েছে সারা দেশে। এখানকার কারিগরদের তৈরি জিনিসপত্র সারা বছরই বাইরের জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

নড়াইলের কামারদের তৈরি জিনিসপত্রের সুনাম রয়েছে সারা দেশে। এখানকার কারিগরদের তৈরি জিনিসপত্র সারা বছরই বাইরের জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন কারণে দিন দিন কামারদের সংখ্যা কমে গেলেও বাপদাদার পেশা টিকিয়ে রেখেছে নড়াইল জেলার বেশ কয়েকটি এলাকার কামারশালার কারিগর। বর্তমানে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামারশালার কারিগর ও শ্রমিকরা। ঈদ সামনে রেখে অন্তত ৩ কোটি টাকার চাপাতি, ছুরি, দা-কাঁচি বিক্রি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বিভিন্ন হাট, বাজার ও গ্রামে দুই শতাধিক কামারশালা রয়েছে। আর এ পেশার সঙ্গে জড়িত আছেন অন্তত ১ হাজার ২০০ কারিগর ও শ্রমিক। 

সরজমিনে দেখা গেছে, নড়াইল সদরের শিঙ্গাশোলপুর বাজারে কামারশালার অন্ধকার ঘরে লোহা পেটানোর শব্দ আর শাণ দেয়ার যন্ত্র ঘুরছে অবিরাম। কয়লায় আগুন ধরাতে  হাপরের  বিশ্রাম নেই। পাশে বাড়ছে পোড়া কয়লার স্তূপ। এসব কামারশালায় ঈদ সামনে রেখে তৈরি হচ্ছে ক্রেতার পছন্দমতো বিভিন্ন আকৃতির চাপাতি, গরু জবাইয়ের বড় ছুরি, চামড়া ছোলার ছোট ছুরি, দা, বঁটি, কুড়াল, কাস্তে, আর ছোট চাকুর মতো লোহার সব গৃহস্থালি সরঞ্জাম। 

এখানকার তৈরি জিনিসপত্র বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা জানান, নড়াইলের কামারদের তৈরি জিনিসপত্রের মান খুব ভালো, অনেক দিন ব্যবহার করা যায়। সারা বছর নড়াইল থেকে এসব লোহার তৈরি জিনিস ক্রয় করে বিভিন্ন জেলায় বিক্রয় করে তাদের ভালো লাভ হয়। 

মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার ব্যবসায়ী আসলাম চৌধুরী জানান, এক যুগেরও বেশি সময় তিনি নড়াইলের শিঙ্গাশোলপুর বাজারসহ  নড়াইলের বিভিন্ন এলাকা থেকে কামারদের তৈরি দা, বঁটি, চাপাতি, ছুরিসহ জনিসপত্র নিয়ে ঢাকা ও সিলেটের কয়েকটি মার্কেটে বিক্রি করেন। খুলনা তেরখাদার এক ব্যবসায়ী নূর আলম জানান, দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় নড়াইলের তৈরি কামারদের জিনিসপত্রের চাহিদা অনেক বেশি। সারা বছরই তিনি এখান থেকে মালপত্র কিনে বিভিন্ন এলাকায় সরবারহ করেন। ঈদের সময় এলে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। 

শিঙ্গাশোলপুর বাজারের কামার দেবু সরদার জানান, তার বাপদাদারা এ পেশায় ছিলেন। তিনিও ছোটবেলা থেকে এ কাজ শিখেছেন। সারা জীবন তিনি কামারশালায় কাজ করেন। সারা বছর তিনি লোহা দিয়ে গৃহস্থালির বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করে তা স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। 

কারিগর দেবু জানান, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে এক থেকে দেড় মাস কাজের চাপ বাড়ে। চলতি মৌসুমে দেড় মাসে তাদের ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার জিনিসপত্র বিক্রি হবে বলে আশা তার। শিঙ্গাবাজারের আরেক কারিগর সুমন বিশ্বাস জানান, সারা বছর কাজের চাপ কম থাকলেও এ সময় কাজের চাপ বাড়ে কয়েক গুণ। কাকডাকা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের। কাজের চাপে ঈদের সময় কামারশালায় নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিতে হয়। শ্রমিক স্বপন দাস জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে ৮০০-১০০০ হাজার টাকা আয় হয়। 

আরেক শ্রমিক শিবু জানান, সারা বছর কামারশালায় কাজ করি। দিনে ৪০০-৪৫০ টাকা আয় হয়। ঈদ এলে আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। কারিগর লিটন দত্ত জানান, সারা বছর কাজের চাপ কম থাকে তখন ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। আর ঈদের সময় কাজের চাপ বেড়ে যায় তখন প্রতিদিনের আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়।  

কমলাপুর এলাকার রতন কামার জানান, একসময় তাদের এলাকায় অনেকেই এ পেশায় ছিলেন। দিন দিন অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছেন। এক যুগ আগে তাদের এলাকায় যে পরিমাণ কামারশালা ছিল বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। তার দাবি ক্ষুদ্র এ ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হলে বাপদাদার পেশাটি ধরে রাখা সম্ভব হবে।  

জেলার তিনটি উপজেলার ছোট-বড় অন্তত ১৫টি হাটবাজারে পাইকারি ও খুচরা বিক্রিয় হয় এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আকারভেদে একেকটি চাপাতি ৬০০-৮০০ টাকা কেজি, পশু জবাই করা ছুরি ৪০০-৫০০ টাকা পিস, ছোট ছুরি ৮০-১০০ টাকা পিস, বঁটি ৫০০- ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা স্বাবলম্বীর নির্বাহী পরিচালক কাজী হাফিজুর রহমান জানান, পৈতৃক পেশা ধরে রাখলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি কামারশালাগুলোয়। তাই এসব কামার পরিবারের ছেলেমেয়েরা নতুনভাবে এ কাজে আসছে না। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক), নড়াইল শিল্পসহায়ক কেন্দ্রের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সুলাইমান হোসেন বলেন, ‘নড়াইলের কামারশালার কারিগরদের তৈরি জিনিসপত্রের মান খুবই ভালো। এসব গৃহস্থালি পণ্যের বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যাপক চাহিদা  রয়েছে। কারিগররা নিজেরা যদি উৎসাহিত হয়ে নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠান করতে চান আমরা তাদের সাহায্য করব। কামারদের আধুনিকায়ন করার জন্য তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা।’

আরও