ব্যবসা জমি প্লট অর্থ

এরশাদের ইনসেনটিভ মডেলেই সেনাবাহিনীকে বশে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা

সেনাবাহিনীর আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে হোটেল, গলফ ক্লাব, ফিলিং স্টেশন, ব্যাংক, শপিং কমপ্লেক্স ও পরিবহন ব্যবসা। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের স্বার্থ ও কল্যাণে ১৯৯৮ সালে এ ট্রাস্ট গঠন করে। পাশাপাশি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও মোংলায় সিমেন্ট কারখানা নির্মাণসহ ব্যবসার জন্য বেশকিছু সুযোগ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে যুক্ত হয় হোটেল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে। ২০২১ সালে যাত্রা করে আর্মি ফার্মা লিমিটেড

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে অনুসরণ করেন পাকিস্তানের কৌশল, যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় দেশটির সেনাবাহিনীকে। এতে বেশ সফলও হন জেনারেল এরশাদ। শেখ হাসিনা সরকারও এরশাদের সে নীতি অনুসরণ করে, যা দীর্ঘ দেড় দশক শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। তাদের মতে, সেনাবাহিনীকে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদের চেয়েও কয়েক গুণ ছাড়িয়ে যান শেখ হাসিনা।

গত দেড় দশকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পায় প্রায় পাঁচ গুণ। আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৪২ হাজার ১৪ কোটি টাকা, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে ছিল ৯ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও পটপরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সাবেক শিক্ষক সারাহ তাসনীম শিহাবউদ্দিন। ‘বাংলাদেশী পলিটিক্স সিন্স ইনডিপেনডেন্স’ শীর্ষক এ গবেষণায় উঠে আসে, সেনা কর্মকর্তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ায় ক্ষমতা দখল করেও কম প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতা গ্রহণের পর এ সামরিক শাসক সেনা কল্যাণ সংস্থাকে শক্তিশালী করেন। পাশাপাশি সেনাসদস্যদের জন্য কম মূল্যে জমি কেনা ও অধিগ্রহণ, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং সেনানিবাসের অবকাঠামোগত উন্নয়নে হাত দেন। সেনাসদস্যদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানোর সুযোগটিও তার হাত দিয়ে শুরু।

সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক সেবাকে ফ্রি করে দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এমন তথ্য জানান মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান চৌধুরী বীর বিক্রম, যিনি ১৯৯৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি নবম পদাতিক ডিভিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। বণিক বার্তাকে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এরশাদ সাহেব সেনাবাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ছাড় দিয়েছিলেন। যেমন বাড়ি ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছিলেন। বিনামূল্যে রেশন দিয়েছেন। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল ফ্রি করেছেন। এছাড়া নিত্যব্যবহার্য অন্য জিনিসপত্রও প্রথমবারের মতো বিনামূল্যে করে দিয়েছিলেন। বাহিনীকে কিছুটা নিজের আনুকূল্যে রাখার প্রচেষ্টা থেকেই মূলত তিনি এ কাজগুলো করেছেন। তবে সেনা কল্যাণ সংস্থা তৈরি করা, রাওয়া ক্লাব নির্মাণ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর সদস্য পাঠানোসহ বেশকিছু পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন পেশাদারত্বের জায়গা থেকে।’

এরশাদের হাতে গড়া সেনাকল্যাণ সংস্থা নানামুখী ব্যবসায় আসে। বর্তমানে সংস্থাটি খাদ্য, সিমেন্ট, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ইন্স্যুরেন্সসহ বেশকিছু ব্যবসা পরিচালনা করছে। অবশ্য এসব পদক্ষেপকে সেনাসদস্যদের নিজের পক্ষে রাখার অংশ হিসেবে দেখছেন না এরশাদ আমলের পানি উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) মনজুর কাদের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে যে নীতিগুলো ছিল সেগুলো এরশাদ সাহেব বাস্তবায়ন করেছেন। উনার সময়ে শুধু নতুনভাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সদস্য পাঠানো শুরু হয়। তাও কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ সুযোগ ওইবারই প্রথম বাংলাদেশের কাছে এসেছিল। সেটিই তিনি গ্রহণ করেছেন। শেখ হাসিনার মতো ব্যক্তিগতভাবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সুযোগ দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তবে শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তখনো সেনাবাহিনীকে আলাদা সুযোগ দেননি। খালেদা জিয়াও এসব করেননি। মূলত ২০০৯ সালের পরই সেনাবাহিনীর সদস্যদের নানা ধরনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল।’

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৮ সালে আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট গঠন করে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের স্বার্থ ও কল্যাণে এ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর পাশাপাশি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও মোংলা সিমেন্ট কারখানা নির্মাণসহ ব্যবসার জন্য বেশকিছু সুযোগ করে দেয়া হয়। নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের মাত্রাটি ছাড়িয়ে যায় অন্য যেকোনো আমলের চেয়ে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে যুক্ত হয় হোটেল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ উদ্বোধন করেন সেনা হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, যা সেনা হোটেল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের আওতায় রয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের বছরই সেনাকল্যাণ সংস্থার অর্থায়নে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ২২ তলাবিশিষ্ট পাঁচ তারকা হোটেল ‘র‍্যাডিসন ব্লু চট্টগ্রাম’। বাদ যায়নি ওষুধ খাতও। মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের (বিএমটিএফ) সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০২১ সালে যাত্রা করে ‘আর্মি ফার্মা লিমিটেড’।

সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিনামূল্যে করে দিয়েছিলেন এরশাদ। বাহিনীকে কিছুটা নিজের আনুকূল্যে রাখার প্রচেষ্টা থেকেই মূলত তিনি এ কাজগুলো করেছেন। তবে সেনা কল্যাণ সংস্থা তৈরি, রাওয়া ক্লাব নির্মাণসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন পেশাদারত্বের জায়গা থেকে —মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান চৌধুরী, বীর বিক্রম

আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে হোটেল, গলফ ক্লাব, ফিলিং স্টেশন, ব্যাংক, শপিং কমপ্লেক্স ও পরিবহন ব্যবসা। চলমান ব্যবসাগুলো হলো ট্রাস্ট ইনোভেশন লিমিটেড, জলতরঙ্গ-লাবনী বিচ, মোংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, আস্থা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, ট্রাস্ট গ্রীন সিটি, ট্রাস্ট ওভারসিজ রিক্রুটিং এজেন্সি, র‍্যাডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন, র‍্যাডিসন ব্লু হোটেল (চিটাগং), আর্মি শপিং কমপ্লেক্স, সেনা হোটেল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, সেনা ফিলিং স্টেশন, ট্রাস্ট ফিলিং অ্যান্ড সিএনজি স্টেশন, সেনাকুঞ্জ, ট্রাস্ট পরিবহন সেবা, জলসিঁড়ি আবাসন, ট্রাস্ট সিকিউরিটিজ, বে ওয়াচ (নির্মাণাধীন), কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, সাভার গলফ ক্লাব, ট্যাক্সি সার্ভিস উইথ তমা পরিবহন এবং প্রজন্ম শিক্ষার্থী হোস্টেল।

শেখ হাসিনার আমলে শুধু প্রফেশনাল গুণ থাকলেই পদোন্নতি হয়নি, সে জন্য তাকে রাজনৈতিকীকরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। হয়তো শেখ পরিবার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা কারো আত্মীয় অথবা গোপালগঞ্জের বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। বোর্ডের বাইরে থেকেও অনেককে প্রমোশন দেয়া হয়েছে —মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর

সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে নেয়াকে প্রথম টার্গেট করেই শেখ হাসিনা সরকার এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। তাদের মতে, কৌশল হিসেবে প্রথম শুরু হয় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া। এরই অংশ হিসেবে বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়। আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়। যুক্ত করা হয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজে।

গত দেড় দশকে সেনাবাহিনীকে অনেকগুলো অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। এসব প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম ‘হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প’। এছাড়া ঢাকা ও আশপাশের সড়ক ব্যবস্থা উন্নয়ন, যানজট নিরসন, হাতিরঝিল ইউলুপ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের শিফটিং নির্মাণ প্রকল্প, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার ও বনানী রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ধানমন্ডি লেক উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প এবং রায়েরবাজার কবরস্থানের উন্নয়ন প্রকল্পেও সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে। এসব কাজে যুক্ত করে পেশাদার একটি সামরিক বাহিনীর মূল লক্ষ্য থেকে সেনাবাহিনীকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। এছাড়া বিভিন্ন আবাসনে প্লট বরাদ্দের মাধ্যমেও সামরিক বাহিনীকে অনুগত রাখার প্রয়াস চালিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর জন্য জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনে এনে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিন্ন পথও অনুসরণ করে শেখ হাসিনা সরকার। ওই বিদ্রোহের সুফল আওয়ামী লীগ সরকার শেষ অবধি পেয়েছে বলে মনে করেন তারা।

১১১ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার, ১১ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার সেনাবাহিনীকে এমন অবস্থা করেছেন যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এটি করে শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন–তোমরা যা চাও দেব, কিন্তু কোনো কথা বলবে না। এ ঘটনার পরই চারশর মতো অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদের অনেকেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল, কর্নেল ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার ব্যক্তি ছিলেন। দেশপ্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও শুধু বিডিআর বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি এবং তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি সমর্থন করেননি বিধায় এমনটি ঘটেছে।’ 

সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা আরো অভিযোগ করেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে শুধু প্রফেশনাল গুণ থাকলেই পদোন্নতি হয়নি, সে জন্য তাকে রাজনৈতিকীকরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। হয়তো শেখ পরিবার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা কারো আত্মীয় অথবা গোপালগঞ্জের বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। এটি করে আমাদের সিস্টেমটা নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া বোর্ডের বাইরে থেকেও অনেককে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। পাঁচ-ছয় বছর আগে এটি শুরু হয়েছিল। এখন এটি তীব্র আকার ধারণ করেছে।’

সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেই অনুসরণ করেছেন শেখ হাসিনা। বিশ্লেষকদের মতে, প্রয়াত জেনারেল এরশাদ অনুসরণ করেছেন পাকিস্তানকে। ব্যবসাসহ নানারকম সুযোগ করে দিয়ে পাকিস্তান যেভাবে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসরণ করেছে, তেমনটির সূত্রপাত বাংলাদেশে করেন জেনারেল এরশাদ।

আন্তর্জাতিক এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে দেশটির সরকার। এমনকি নব্বইয়ের দশকে বেনজীর ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও সেনাবাহিনীকে নানা রকম ব্যবসার সুযোগ করে দেন। মূলত সে সময় থেকেই পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ব্যবসাগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কোনো ধরনের কথা বলেনি। দেশটিতে এখনো সেনাবাহিনীকে নানাভাবে ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের ভারী উৎপাদন শিল্পের এক-তৃতীয়াংশই এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া ব্যাংক থেকে শুরু করে বেকারি, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো বেশকিছু খাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যবসা করছে। বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাইভেট প্রপার্টির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের।

সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেম্বলির প্রকাশিত তথ্যমতে, সেনাবাহিনীর অধীনে ৪০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের রয়েছে সিমেন্ট উৎপাদন, আবাসন প্রকল্পসহ মোট ৫০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দেশটির ভূমির প্রতি সেনাবাহিনীর আকর্ষণ নতুন নয়। এরই উদাহরণস্বরূপ কৃষি শহর হিসেবে পরিচিত পাঞ্জাবের ওকারা শহরে সেনাবাহিনীর ফার্ম বহুল আলোচিত একটি বিষয়। শহরটির ১৭ হাজার একর ভূমি নিয়ে কৃষকের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও জড়ায় সেনাবাহিনী। ওকারা শহরই কেবল নয়, কৃষিনির্ভর পাকিস্তানের অন্যান্য কৃষি জমি ও কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

কোনো সদস্য অনিয়ম করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়াই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়ম। তবে শেখ হাসিনা সরকারের সময় সে চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায় বলে বাহিনীটির অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান। এসব বিষয়ে ছাড় দিয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান মূলত অনিয়মকারীদের নিজের কাছে দায়বদ্ধ রেখে সব নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন বলেও জানান তারা।

সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের অডিট রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১৩ হাজার ১২৯ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সেনানিবাসের ভেতরে এ-১ শ্রেণীর জমি ইজারা না নিয়েই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পরিচালনা বাবদ সরকারের রাজস্ব ক্ষতি, বার্ষিক খাজনা অনাদায়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি, ইজারার প্রিমিয়ারের ওপর ভ্যাট অনাদায় ও দণ্ডসুদ বাবদ সরকারের রাজস্ব ক্ষতি, ইজারার চুক্তিমূল্যের আয়কর অনাদায় ও দণ্ডসুদ বাবদ সরকারের রাজস্ব ক্ষতি এবং ইজারা ও ভাড়া বাবদ আদায়কৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করার মতো অনিয়ম সামনে আসে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে মোটেও পছন্দ করতেন না। বরং পুলিশকে নিজের অনুকূলে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পুলিশকে তিনি সেনাবাহিনীর প্যারালাল বানানোর কাজ করে গেছেন। তবে সেনাবাহিনীকে নিজের অনুকূলে রাখার জন্য সবকিছুই করেছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, নারী ও মদ্যপানের মতো অভিযোগ এলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হতো না। বরং কাউকে কাউকে শেখ হাসিনা সরাসরি বলতেন—“তুমি কী করেছ আমি কিন্তু জানি”। এছাড়া সেনাবাহিনীর প্রকল্প নির্মাণের ঘটনায় উচ্চপদস্থদের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় উনি নীরবতা দেখিয়েছেন।’

সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও নানা অনিয়মগুলোয় নীরব ভূমিকা পালন করেছেন বলে গত শনিবার রাওয়া ক্লাবে ‘বৈষম্যবিরোধী সশস্ত্র বাহিনী–বাংলাদেশ ২.০ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ শীর্ষক সেমিনারে অভিযোগ করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে গুম করা হয়। গুমের সময়গুলোয় আমার পরিচিত মানুষজনই উপরের নির্দেশ পালন করেছেন। এমনকি আমার বিরুদ্ধে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে সময় জেনারেলরা চুপ ছিলেন। আমার কোর্সমেটসহ পরিচিতরা আমার ও আমার পরিবারের খোঁজখবর নিতে ভয় পেত।’

আরও