পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মালয়েশিয়া যাওয়ার ভাড়া

জনশক্তি রফতানির দিক থেকে দেশের চতুর্থ বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর দেশটিতে জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম আবারো শুরু হয়েছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কভিড-১৯ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় মালয়েশিয়ায় ভ্রমণেচ্ছু বাংলাদেশীদের সংখ্যাও বেড়েছে। যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া

জনশক্তি রফতানির দিক থেকে দেশের চতুর্থ বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর দেশটিতে জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম আবারো শুরু হয়েছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কভিড-১৯ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় মালয়েশিয়ায় ভ্রমণেচ্ছু বাংলাদেশীদের সংখ্যাও বেড়েছে। যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া রুটের উড়োজাহাজ ভাড়া। এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ছয় মাসে রুটে উড়োজাহাজের টিকিট ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ। আবার টিকিট পাওয়াও হয়ে উঠেছে দুষ্কর।

জানা গেছে, ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বর্তমানে মোট পাঁচটি কোম্পানি সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এগুলো হলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউএস-বাংলা, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস, এয়ার এশিয়া মালিন্দো এয়ার। সপ্তাহে অর্ধশতাধিক ফ্লাইট দুই শহরের মধ্যে যাত্রী পরিবহন করে। এছাড়া থাই এয়ারওয়েজ, শ্রীলংকান এয়ারলাইনস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, হিমালয়া এয়ারলাইনস, ইন্ডিগো এয়ারলাইনস ক্যাথে প্যাসিফিকও বিভিন্ন জায়গায় বিরতি দিয়ে রুটে যাত্রী পরিবহন করে। সম্প্রতি রুটে টিকিটের চাহিদা এতই বেড়েছে যে সে সুযোগে এয়ারলাইনসগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। টিকিট অনেকটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় বাড়তি দাম দিয়েই তা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।

আকাশপথে যাত্রীসেবার গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, আগামীকাল ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে ইকোনমি ক্লাসে মালিন্দো এয়ারলাইনসের ভাড়া দেখানো হয়েছে ৯০ হাজার ৮২৬ টাকা। একই রুটে ২০ জানুয়ারি মালিন্দো এয়ারের ভাড়া দেখানো হয়েছে ৭২ হাজার ৯৫০ টাকা, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ৭৫ হাজার ৯৪৬ টাকা, ইউএস-বাংলার ভাড়া ৯০ হাজার ৬১৮, ইন্ডিগোর ৪৫ হাজার ৯০০ (চেন্নাইয়ে যাত্রাবিরতি), শ্রীলংকান এয়ারলাইনসের ৬৪ হাজার ৫৮০ টাকা (কলম্বো হয়ে) পরদিন ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া দেখানো হয়েছে ৬৪ হাজার ৭০০ টাকা, থাই এয়ারওয়েজের ৬৬ হাজার ৩০০ (ব্যাংকক হয়ে) মালিন্দো এয়ারের ৭২ হাজার ৯৫০ টাকা। এছাড়া ২২ জানুয়ারি রুটে থাই এয়ারওয়েজের ভাড়া দেখানো হয়েছে ৪৫ হাজার ১০০ টাকা, মালিন্দোর ৬৬ হাজার ৭০০ মালয়েশিয়ান এয়ারের ৭১ হাজার ২০০ টাকা।

তবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের শেষ ভাগে দাম কিছুটা কম দেখানো হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া দেখানো হয়েছে ৬১ হাজার ৬৭ মালিন্দো এয়ারলাইনসে ৭৫ হাজার ৯৪৬ টাকা। ঠিক এক মাস পর ২০ ফেব্রুয়ারি রুটে ইকোনমি ক্লাসে ইন্ডিগো এয়ারের ভাড়া হবে ৪৪ হাজার ২০ টাকা, থাই এয়ারের ৪৫ হাজার ১০০ (ব্যাংকক হয়ে), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ৪৯ হাজার ২০০, মালিন্দোর ৫৬ হাজার ৯০০ মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া হবে ৭১ হাজার ২০০ টাকা।

এখন থেকে ছয় মাস আগেও রুটের বিমানের টিকিট মূল্য ছিল হাতের নাগালে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ে ২০-২৫ হাজার টাকায় টিকিট বিক্রি করেছে ট্রাভেল এসেন্সিগুলো। এখন বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার কথা জানালেন ট্রাভেল এজেন্টরা। তারা বলছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন। সেই সুযোগে এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রসঙ্গে ফ্লাইওয়ে ট্রাভেলের সিইও ইয়াসির আরাফাত বণিক বার্তাকে বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাতায়াত শুরুর পর থেকেই বিমান ভাড়া বাড়তে শুরু হয়েছে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ে আমরা ২০-২৫ হাজারের মধ্যে বিভিন্ন এভিয়েশন কোম্পানির টিকিট বিক্রি করতে পেরেছি। তবে আগস্টের পর ভাড়া বৃদ্ধি শুরু হয়েছে। এখন মালয়েশিয়ার টিকিট মানেই যেন সোনার হরিণ।

তিনি আরো বলেন, এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে যে উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেই টিকিট কিনতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (অটাব) সভাপতি এসএন মঞ্জুর মোর্শেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে ভাড়া বৃদ্ধি একেবারে অযৌক্তিক। ভাড়া হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ২০-২২ হাজার টাকা। ছয় মাস আগেও ২০-২৫ হাজার টাকা ছিল। এখন মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে এয়ারলাইনসগুলো ডলারের দাম, তেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলছে।

তবে কুয়ালালামপুর রুট ছাড়া অন্য কোনো রুটে এত ভাড়া বাড়েনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রুটে যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। কারণ শ্রমিকরা এখন মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন। সেই সুযোগে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে ভাড়া বৃদ্ধি আমরা সমর্থন করি না।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটির বৈঠকে ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শ্রমবাজার খুলতে নানামুখী কূটনৈতিক তত্পরতা চালায় ঢাকা। ফলে গত বছরের আগস্ট আবারো জনশক্তি নিতে শুরু করে দেশটি।

বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ-ছয় হাজার কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার ছাড়পত্র দিচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখার পরিচালক কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশীদের জন্য খুলেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রতি সপ্তাহে পাঁচ-ছয় হাজার লোকের বিপরীতে মালয়েশিয়ার ছাড়পত্র ইস্যু করছি।

যাত্রীর চাপ বেশি হওয়ার কারণে বিমানের ভাড়া বেড়েছে বলে স্বীকার করেছেন এয়ারলাইনসগুলোর কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে ডলার জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধিকেও দায়ী করছেন তারা।

মালয়েশিয়ায় সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনাকারী বিদেশী এয়ারলাইনস কোম্পানির এক মহাব্যবস্থাপক বণিক বার্তাকে বলেন, আসন সংখ্যার তুলনায় এখন চাহিদা বেশি। এছাড়া কয়েক বছর আগে অনেকেই রুটে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। এখন সেই প্রভাবটা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ার কারণে ভাড়া অনেক বেশি দেখাচ্ছে। অর্থাৎ আগে ডলার রেট ৮০-৮২ টাকা যখন ছিল তখন ভাড়া ছিল এক রকম, আবার এখন ডলার রেট অনেক বেশি; এটাও হিসাব করতে হবে।

তবে ভাড়া বৃদ্ধির কারণ তাত্ক্ষণিকভাবে বলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার। তিনি বলেন, নানা কারণে উড়োজাহাজের ভাড়া কম-বেশি হয়। এটা গবেষণার বিষয়।

প্রসঙ্গে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটে সব এয়ারলাইনস মিলে যে পরিমাণ সিট ক্যাপাসিটি আছে, এখন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি চাহিদা। যার কারণে টিকিট ছাড়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতারা টিকিট কিনে নিচ্ছেন। এখন আসন নিশ্চিত করাই মুখ্য, দাম নয়। অবস্থায় সরকার যদি ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

আরও