চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ‘জাঙ্গালিয়া’

লবণ ও মৎস্যবাহী গাড়ির পানিতে পিচ্ছিল আঁকাবাঁকা পথ হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ

দেশের ব্যস্ততম সড়কগুলোর একটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। দুই লেনের এ পথে চলাচল করে সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন যানবাহন।

দেশের ব্যস্ততম সড়কগুলোর একটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। দুই লেনের এ পথে চলাচল করে সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন যানবাহন। পর্যটন নগরী কক্সবাজারগামী এ যানবাহনগুলো প্রায়ই লোহাগাড়ার জাঙ্গালিয়া কিংবা চুনতি অভয়ারণ্য এলাকায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সর্বশেষ ঈদের সময়েও পৃথক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৫ জন। অভয়ারণ্যের উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এ সরু পথে বেশি দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে অনেকেই দিচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। তবে খোঁজ নিয়ে যানা যায়, মূলত লবণ ও মৎস্যবাহী যানের পানিতে পিচ্ছিল হয়ে ভোর কিংবা সকালে বিপজ্জনক করে তুলছে সড়কটিকে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

দেশের প্রধান লবণ উৎপাদনকারী জেলা কক্সবাজার। ২৫ লাখ টনের মতো উৎপাদিত লবণ এ পথেই সারা দেশে প্রবেশ করে। লবণের পানিতে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে মধ্যরাতের পর চলাচল করে লবণবাহী যানবাহন। আবার বিভিন্ন বাহনে করে সারা দেশে নিয়ে যাওয়া হয় ওই অঞ্চলের মাছ। ফলে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর লবণপানি কিংবা মাছের পানি পড়ে মারাত্মকভাবে পিচ্ছিল হয়ে যায়। প্রতি বছর এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ও লবণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংগঠনকে সতর্ক করা হয়। লবণ ও মাছ পরিবহনের সময় বাড়তি সতর্কতা ও পলিথিন ব্যবহারের নির্দেশনাও দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক সে নির্দেশনা অমান্য করায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানান পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনসহ বিসিকের কর্মকর্তারা। লোহাগাড়ার ওই এলাকায় গত এক বছরে পৃথক দুর্ঘটনায় ৯০-এর অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

যোগাযোগ করা হলে বিসিক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক মো. মোতাহার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লবণ পরিবহনের ফলে সড়কে নিঃসৃত পানির কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অমূলক নয়। আমরা বিষয়টি নিয়ে সচেতন। এরই মধ্যে চাষীদের এ বিষয়ে সচেতন করতে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে বিসিক। তবে সওজসহ অন্যান্য সংস্থাকেও সড়ক সম্প্রসারণ, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ লবণবাহী যান থেকে পানি পড়লে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। বিসিক বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জানাবে।’

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি এলাকার রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে গতকাল সকাল সোয়া ৭টার দিকে বাস-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান সাতজন। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো দুজন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজনের মৃত্যু হয়। তারা সবাই স্বজন বলে জানা গেছে। ঈদের ছুটিতে কুষ্টিয়া থেকে যাচ্ছিলেন কক্সবাজার। এর আগে ঈদের দিন সকালে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন একই স্থানে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল মুক্তিযোদ্ধা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম সাংবাদিকদের জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কটি শিগগিরই চার লেনে উন্নীত করা হবে। দুর্ঘটনাকবলিত এলাকাটির সড়কের উভয়দিকে এক কিলোমিটারের মধ্যে গতিরোধক স্থাপনের কাজ শুরু হবে। সড়কে লবণবাহী গাড়ি চলাচলে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে বিআরটিএ ব্যবস্থা নেবে। হাইওয়ে পুলিশকে সবসময় সতর্ক থাকার নির্দেশনার পাশাপাশি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো শনাক্ত করে নিরাপত্তা জোরদার, যানবাহনের গতি নির্ধারণ করে দুর্ঘটনা কমানোর নিশ্চয়তা দেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে এসেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার তিন অংকের ঘরে থাকলেও গত মার্চে চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার ছিল ৫০-এর নিচে। তবে বিভাগে দুর্ঘটনা কমলেও কক্সবাজার অঞ্চলের দুর্ঘটনা সার্বিক চিত্রকে পাল্টে দিচ্ছে। মার্চে বিভাগের ১১টি জেলায় ৪৮টি দুর্ঘটনায় ৪৯ জনের মৃত্যু হলেও ঈদের ছুটিতে দুইদিনের দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। প্রতি মাসেই বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে। এর আগে ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট বাজারসংলগ্ন এলাকায় ভোর ৫টায় একসঙ্গে পাঁচ ভাই মারা যান। পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে একটি পিকআপের চাপায় তাদের মৃত্যু হয়।

দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শুভরঞ্জন চাকমা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জাঙ্গালিয়াসহ লোহাগাড়ার বেশকিছু অংশের সড়ক উঁচু-নিচু। ঝুঁকির বিষয় হচ্ছে সড়কটির পূর্ব অংশ নিচু এবং পশ্চিম অংশ উঁচু। অতিরিক্ত গতির ফলে আঁকাবাঁকা পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে যানবাহনগুলো। আবার লবণ মিশ্রিত পানির কারণেও সড়কটি বিপজ্জনক হয়ে যায়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বাইরে থেকে আসা যানবাহনচালকরা এখানকার সড়কের সংকটগুলো বুঝতে পারেন না। লোহাগাড়াসহ এ অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের সড়কপথের দূরত্ব প্রায় দেড়শ কিলোমিটার। এটি মহাসড়ক হলেও নানা কারণে সম্প্রসারণে নেয়া প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সড়কটির চট্টগ্রাম থেকে কেরানীহাট পর্যন্ত অংশ সম্প্রসারণ করে ৩৪ ফুটে (প্রস্থ) উন্নীত করা হলেও কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কটির প্রস্থ এখনো ২০-২২ ফুট। দেশের বিভিন্ন উপজেলা সড়কগুলোর চেয়েও সরু এ সড়ক দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করে। পাহাড়ি সরু ও আঁকাবাঁকা পথের কারণে অন্য অঞ্চলের যানবাহনচালকরা এ সড়কের ধরন বুঝতে পারেন না। বিশেষ করে রাতে লবণ ও মাছের যানবাহন থেকে নিঃসৃত পিচ্ছিল পানি সড়ককে বিপজ্জনক করলে দ্রুতগতির এসব যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়কটি সম্প্রসারণ কিংবা আঁকাবাঁকা অংশে ট্রাফিক ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নেয়া না হলে দুর্ঘটনার পরিমাণ আরো বাড়বে বলে শঙ্কা জানিয়েছেন সওজের প্রকৌশলীরাও।

নাম প্রকাশ না করে সওজের একজন প্রকৌশলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত এক বছরে লোহাগাড়াসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে হওয়া দুর্ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে ভোর কিংবা সকালে। লবণবাহী যানবাহনগুলো চলাচলের পর সড়কে পড়ে থাকা পানি, বালি ও ভোরের কুয়াশার সঙ্গে মিশে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সওজের পক্ষ থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কিছুই করার নেই। তবে জাইকার অর্থায়নে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। সম্প্রসারণ ও যানবাহনগুলোর সাবধানতা ছাড়া এ সড়কের দুর্ঘটনা এড়ানো অসম্ভব।’

সওজ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লোহাগাড়া এলাকার চুনতি অভয়ারণ্যের কারণে সড়কটির প্রস্থ খুবই কম। কোথাও কোথাও প্রস্থ মাত্র ২০ ফুটে নেমে এসেছে। সওজের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম-কেরানীহাট অংশের প্রস্থ বাড়িয়ে ৩৪ ফুটে উন্নীত করা হলেও লোহাগাড়াসহ বেশ কয়েকটি বনাঞ্চলের সড়ক প্রশস্ত করা যায়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা বন বিভাগের অনুমতি ব্যতীত সড়ক সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। এ কারণে সারা দেশ থেকে আসা পর্যটকবাহী বাস, মাইক্রোবাস কিংবা প্রাইভেট কারগুলো ঝুঁকি নিয়েই এ সড়কে চলাচল করছে। সড়ক সম্প্রসারণ না হওয়া পর্যন্ত ট্রাফিক আইন মেনে চলাসহ গতি নিয়ন্ত্রণাদেশে কড়াকড়ি আরোপ, পণ্যবাহী যানবাহনগুলোর জন্য বিশেষ সচেতনতা বাড়ানো না গেলে দুর্ঘটনা কমবে না বলে শঙ্কা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী (কক্সবাজার) মো. রোকন উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর আমরা ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছি। এ স্থানে একাধিক দুর্ঘটনার ফলে সড়ক প্রশস্ত করা, গতি নিয়ন্ত্রণাদেশ দেয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত গতিবেগে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক বহু লেনে উন্নীত করার আগে দুর্ঘটনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকেই মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতার মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করবে।’

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অপ্রশস্ত মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য লবণবাহী যানবাহনের ভূমিকা অনেক বেশি বলে মনে করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. সালাহ উদ্দিনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি এবং সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যৌথ মিটিংয়ে বিষয়টি বিসিকসহ লবণ ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাতের আঁধারে কেউ যদি লবণ পরিবহনের ক্ষেত্রে পলিথিন ব্যবহার না করে সেটি তদারক করা কঠিন। এর পরও বিষয়টি নিয়ে আমরা সওজসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। লবণ চাষী, লবণ ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকদের নিয়মের মধ্যে আনতে যা যা করা প্রয়োজন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেটি করা হবে।’

আরও