রিজার্ভের পতনে বিদেশী বিনিয়োগে ভাটা নামে

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ও রিজার্ভে উন্নতি না হলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না

কভিডের অভিঘাত পার করে যে সময় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার জোরালো হয়ে ওঠার কথা, ঠিক সে সময়েই দেশের রিজার্ভে পতন শুরু হয়। এর সমান্তরালে একই সময় নিম্নমুখী হয়ে ওঠে এফডিআই প্রবাহ। বিষয় দুটি একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভের পতন যখন শুরু হয়েছে তখন থেকেই দেশে এফডিআই প্রবাহ নিম্নমুখী

কভিডের সময় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের বছর ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। কভিডের অভিঘাত পার করে যে সময় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার জোরালো হয়ে ওঠার কথা, ঠিক সে সময়েই দেশের রিজার্ভে পতন শুরু হয়। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ তা নেমে আসে ২৭ দশমিক ১৩ বিলিয়নে। তবে সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এ হিসাবায়ন পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ক্রমাগত রিজার্ভ কমতে থাকায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ বাংলাদেশ সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী গত বছরের জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ পদ্ধতিতে এর হিসাবায়ন শুরু করে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ পতনের এ পুরো সময়ে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহও ছিল নিম্নমুখী ধারায়।

বিষয় দুটি একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভের পতন যখন শুরু হয়েছে তখন থেকেই দেশের বিদেশী বিনিয়োগ নিম্নমুখী। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা না ফিরলে ও রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না।

ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বিনিয়োগকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে নিয়ে আসা অর্থসংক্রান্ত জরিপের ভিত্তিতে এফডিআই প্রবাহের পরিসংখ্যান ও গতিপ্রকৃতির তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে নতুন মূলধন (ইকুইটি ক্যাপিটাল), পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় (রিইনভেস্টেড আর্নিংস) ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ (ইন্ট্রাকোম্পানি লোন) এ তিন ভাগে এফডিআই প্রবাহ হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। কিন্তু নতুন মূলধন বা বিনিয়োগ দেশে আসছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটার্নাল ডেবট; জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার, সে সময় দেশে এফডিআই স্টক বা পুঞ্জীভূত বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ২১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে এফডিআই স্টক ছিল ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নে রিজার্ভ নেমে আসে ২৭ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে। গত বছরের জুন পর্যন্ত শুধু এ পদ্ধতিতেই হিসাব প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরের মাস জুলাইয়ে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বা বিপিএম৬ পদ্ধতিতে করা হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সাল শেষে দেশে রিজার্ভের আকার ছিল ২১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময় দেশে এফডিআই স্টকের আকার নেমে আসে ২০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিডের পর অনেক বিনিয়োগকারী চীন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে অন্যান্য গন্তব্যে নিয়ে গেছে। ফলে ওই দেশগুলোর বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু রিজার্ভ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে পারেনি। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতের দুর্দশাও এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে মুনাফা প্রত্যাবাসন নিয়ে বহুজাতিক ও বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপত্তিও এফডিআই আকর্ষণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দিয়েছে।

রিজার্ভ সংকট সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করে গত বছর। এ সময় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে ডলার সংকটের কারণে লভ্যাংশ, রয়্যালটি ফিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি) লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার (বিডি) লিমিটেড ও ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেডকে এক্ষেত্রে বেশি সমস্যায় ভুগতে হয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তে রিজার্ভের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অবশ্যই এটি একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ বিনিয়োগকারীরা চাইবে তারা যেন লভ্যাংশ কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়া প্রত্যাবাসন করতে পারে। সেখানে যদি তারা দেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি বা অবস্থা ভালো না, তখন তার একটা শঙ্কা তৈরি হয়। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কোনো আলোচনার ব্যবস্থা করা ও তাদের আশ্বস্ত করা। বিদেশী বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে আস্থার সংকট এবং অনিশ্চয়তা।’

তিনি বলেন, ‘দেশে বিদেশী বিনিয়োগের যে প্রবাহ, তা মূলত বিদ্যমান বিনিয়োগের আয় থেকে পুনরায় করা বিনিয়োগ। নতুন বিদেশী বিনিয়োগ যদি বাংলাদেশে বেশি করে আসত, তা রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়নেও সহায়তা করত। রিজার্ভের মূল উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে রফতানি ও রেমিট্যান্স। আরেকটি উৎস হলো বিদেশী ঋণ। এফডিআই আকর্ষণে অন্য অনেক দেশ সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে সফলতা দেখাতে পারেনি। গত এক বছরে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা করতে হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ থেকে অর্থ প্রত্যাবাসনে ঝামেলার কথা উল্লেখ করেছে।’

একই বক্তব্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে ‘২০২৪ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট স্টেটমেন্টস: বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পণ্যমূল্য এবং উচ্চ আমদানির কারণে ২০২৩ সালে ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে তা ক্রমান্বয়ে কমেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়ায় ২১ বিলিয়নের ঘরে। আর ব্যবহারযোগ্য তথা নিট রিজার্ভ ছিল আরো কম। তবে তা ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশ করা হতো না। এ সংকটের মুখে তৎকালীন সরকার বৈদেশিক মুদ্রায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দেনা পরিশোধ বিলম্বিত করে তোলে। এছাড়া দেশ থেকে বাইরে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন অপরিহার্য করে তোলে। এ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এমন এক সময় দেখা দেয়, যখন বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে দেয়া বৃহৎ ও সন্দেহজনক ঋণ খেলাপি হয়ে পড়া সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি আলোচনায় ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংক ব্যবস্থায় নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) আকার ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থকে ছাড়িয়ে যায়। এর বেশির ভাগেরই কোনো হদিস পায়নি সরকার। ২০২৩ সালের জুন নাগাদ তা ১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থকে ছাড়িয়ে যায়, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ শতাংশেরও বেশি।

এতে আরো বলা হয়, বিগত এক দশকে বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণের মতো বিনিয়োগসংক্রান্ত বাধাগুলো প্রশমনে ধীরে ধীরে কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়নে সীমিত উপকরণ, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, শ্রম আইনের শিথিল প্রয়োগ এবং দুর্নীতি বিদেশী বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতিরও। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো বিকশিত হচ্ছে এবং আর্থিক খাতও ব্যাংকগুলোর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ২০২২ সালে এ ব্যাংক খাত বড় এক কেলেঙ্কারির শিকার হয়, যার মধ্য দিয়ে ১১ ব্যাংকের সম্মিলিত ঘাটতি ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থকে ছাড়িয়ে যায়। ব্যবসায়িক বিরোধের ন্যায্য সমাধানের পথকে বাধাগ্রস্ত করে শ্লথ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিচার ব্যবস্থা এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ।

এফডিআই স্টক বিবেচনায় বাংলাদেশের বিদেশী বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশটির এফডিআই স্টকের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, রিজার্ভ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক। পাশাপাশি টেকসই নীতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব ক্ষেত্রে বিগত দিনগুলোয় দুর্বলতা ছিল বাংলাদেশের।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রিজার্ভ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে একটা বড় ফ্যাক্টর। পাশাপাশি দেশের ব্র্যান্ডিং, দুর্নীতি—এর সূচকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। আমার মতে রিজার্ভের পাশাপাশি এ সূচকগুলো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নজরদারিতে থাকে। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতিও পর্যবেক্ষণ করেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ব্যর্থতায় নীতিনির্ধারণী সংস্থা ও আমলাতন্ত্রও বড় ভূমিকা রেখেছে। বিনিয়োগ আকর্ষণের মানসিকতার ঘাটতি বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগে অনাস্থা সৃষ্টি করেছে বিগত দিনগুলোয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্যাপ সৃষ্টি হয়।’

২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা এফডিআই স্টকের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। দেশে এফডিআই স্টকের পঞ্চম বৃহত্তম উৎস চীনা মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশী বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, রিজার্ভ পরিস্থিতি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে। কারণ এটি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সামর্থ্য প্রকাশ করে, যা বিনিয়োগ আকর্ষণের দরকষাকষিতেও বাংলাদেশকে ইতিবাচক অবস্থানে রাখার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রিজার্ভ পরিস্থিতি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে। কারণ রিজার্ভ দিয়ে একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার প্রতিফলন ঘটে। বড় প্রকল্প করার ক্ষেত্রে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হলে, সেটার সক্ষমতা কতটুকু আছে তাও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বিবেচনার উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। নীতিকাঠামোর মধ্যে কর, আয়, অর্থ পরিশোধ, ঋণপত্র নিষ্পত্তির সক্ষমতার মতো বিষয়গুলো অনুধাবনের ক্ষেত্রে রিজার্ভ বড় ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে একজন বিদেশী বিনিয়োগকারীর জন্য রিজার্ভ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক। যে দেশে রিজার্ভ যত বেশি হবে, সেই দেশ বিনিয়োগ নিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে তত ভালো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে। যেকোনো নিরিখে রিজার্ভ একটি বড় প্রভাবক।’

বাংলাদেশে এফডিআই স্টকের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস নেদারল্যান্ডস। গত বছর ডিসেম্বর শেষে দেশটির এফডিআই স্টকের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে রিজার্ভ পরিস্থিতি বড় ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি বিনিয়োগ পরবর্তী সেবা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বিনিয়োগ আকর্ষণের বড় নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখে।

ডাচ্‌-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সওকত আফসার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রিজার্ভ পরিস্থিতি ও সামষ্টিক অর্থনীতি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। এগুলো ইতিবাচক না থাকলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনিরাপদ বোধ করে। সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগকারীর আস্থায় বড় প্রভাব ফেলে। এটাই বিনিয়োগ না আসার মূল কারণ। এছাড়া দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ সংশ্লিষ্ট সেবাগুলো দুর্বল। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হলেও তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ আছে এবং সেই আকর্ষণ থেকে তারা বিনিয়োগ নিয়ে আসেও। কিন্তু আমরা ধরে রাখতে পারি না, তারা চলে যায়। একই জায়গা থেকে সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করা যায় না বলেই তারা বিনিয়োগ না করে ফিরে যায়। এছাড়া প্রকৃত অংশীদার খুঁজে না পাওয়াও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।’

এফডিআই স্টক বিবেচনায় বাংলাদেশে নবম শীর্ষ বিদেশী বিনিয়োগের উৎস দেশ ভারত। বাংলাদেশে গত ডিসেম্বর শেষে ভারতের এফডিআই স্টকের পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ২২ লাখ ডলার। এ দেশ সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশী বাণিজ্য সংগঠন প্রতিনিধির দাবি, রিজার্ভ থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতির পরিস্থিতি উপস্থাপনে বিগত বছরগুলোয় মিথ্যাচার করা হতো, যা বিনিয়োগ আকর্ষণ ব্যর্থতায় বড় ভূমিকা রেখেছে।

ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) যুগ্ম মহাসচিব মো. আব্দুল ওয়াহেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পটপরিবর্তন হয়েছে। এর আগে রিজার্ভ থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতির পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হতো মিথ্যাচারের মাধ্যমে। এখন প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন শুরু হয়েছে। বিদেশী ঋণও পরিশোধ হচ্ছে রিজার্ভ ব্যবহার ছাড়াই। এটা ভালো লক্ষণ, কারণ এ তথ্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি। আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতির ইতিবাচক প্রবণতায় বাংলাদেশের অবস্থান অচিরেই সুসংহত হবে। গত সরকারের মিথ্যাচারে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছিল না। এখন তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।’

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোর সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি করার সক্ষমতা (যেমন কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি), লভ্যাংশ প্রদান এবং প্রত্যাবাসন ক্ষমতার সঙ্গে রিজার্ভের সম্পর্ক আছে, যা বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন।’

আরও