২০২৪ সাল

আগস্টের পর স্বাভাবিক ছিল চিনি ছাড়া অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানি

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের গোটা শেষার্ধজুড়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

দেশে গত বছর সামান্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে ভোজ্যতেলের আমদানি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, সদ্য বিদায় নেয়া ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের সম্মিলিত আমদানি কমেছে ১ শতাংশের কিছু বেশি। একই সময়ে চিনির আমদানি কমেছে ৩২ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২৪ সালে দেশে অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যগুলোর মধ্যে ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি কমলেও বেড়েছে শুধু গমের। গত বছর দেশে খাদ্যশস্যটির আমদানি বেড়েছে ৩৪ শতাংশেরও বেশি।

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের গোটা শেষার্ধজুড়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, ব্যাংক খাতে শুরু হওয়া অস্থিরতার মতো আগস্ট ও আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাবলি অর্থনীতিতে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। তবে এর মধ্যেও চিনি ছাড়া অতি প্রয়োজনীয় অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক পর্যায়েই ছিল বলে এনবিআরের হিসাবে উঠে এসেছে।

২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ সংকটের কারণে দেশে গমের আমদানি ব্যাপক মাত্রায় কমে আসে। তবে তা গত বছর আবার বেড়ে স্বাভাবিক পর্যায়েই চলে এসেছে। ভোজ্যতেলের আমদানি কমলেও তা ছিল ১ শতাংশের আশপাশে। আর অবৈধ পথে অনানুষ্ঠানিক পন্থায় আমদানির মতো কিছু বিষয় চিনির প্রাতিষ্ঠানিক আমদানি ব্যাপক মাত্রায় কমে যাওয়ার পেছনে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা।

এনবিআরের হিসাবে, সদ্য বিদায় নেয়া বছরে দেশে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল মিলে মোট ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৬৫ হাজার টন। এজন্য আমদানিকারকদের শুল্কায়িত মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে ২৪ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৮৮ হাজার টন, যার মূল্য ছিল ২৩ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি কমেছে ২৩ হাজার টন বা ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশের কিছু বেশি।

দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন। যদিও গত বছর দেশে পণ্যটির আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৬৮ হাজার টন, যার মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছিল ৯ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৭ লাখ ১২ হাজার টন চিনি। সে অনুযায়ী, গত বছর দেশে পণ্যটির আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আমদানি কমলেও পণ্য দুটির আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় বহুলাংশেই বেড়েছে ব্যবসায়ীদের। বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো পণ্যগুলোর আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও এগুলো আমদানিতে আগের বছরের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের। পণ্যগুলোর সরবরাহ কমে যাওয়ার বিপরীতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে লাগামহীন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে।

ভোগ্যপণ্য আমদানিতে যুক্ত প্রতিষ্ঠান সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেশকিছু অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের আমদানি পরিমাণের দিক থেকে সেভাবে না বাড়লেও অর্থমূল্যে ব্যয় কিন্তু ঠিকই বেড়েছে। ২০২৪ সালে ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খুলতে তার আগের বছরের তুলনায় সহজ হয়ে এলেও ডলারের বিনিময় হারে স্থানীয় মুদ্রায় আমাদের অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়েই আমাদের ব্যবসা পরিচালনায় একটি বড় চাপ তৈরি হয়েছে। আর এখন তো এ চাপ আরো বড় হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।’

দেশে ভোজ্যতেলের বাজারের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আসন্ন রমজানে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম সহনীয় রাখতে ভোজ্যতেলের ওপর শুল্ক, কর ও ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআর। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেল আমদানিতে শীর্ষস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই), টি কে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল (রূপচাঁদা ব্র্যান্ড)। বর্তমানে এ বাজারে আবুল খায়ের গ্রুপের অবস্থানও শক্তিশালী হতে দেখা যাচ্ছে। এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মাইল ফুড প্রডাক্টস পাম ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এনে পরিশোধনের পর জাহাজ মার্কা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বাজারজাত শুরু করেছে। পাম অয়েলের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা সাধারণত ভোজ্যতেলটি অপরিশোধিত অবস্থায় এনে বাজারজাত করেন। আর সয়াবিন তেল অপরিশোধিত অবস্থায় এনে তা দেশেই পরিশোধন করে বাজারজাত করা হচ্ছে।

স্থানীয় সুগার মিলগুলো থেকে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় চিনিতেও আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে বাংলাদেশের। পণ্যটির আমদানিকারকরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈধপথে পণ্যটির আমদানি ব্যাপক মাত্রায় কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো চোরাপথে পণ্যটির অনানুষ্ঠানিক আমদানি বেড়ে যাওয়া। গত বছর রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার সুযোগে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রচুর নিম্নমানের চিনি আমদানি হয়েছে।

২০২৩ সালে দেশে গম আমদানিতে ব্যাপক মাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। সেবার পণ্যটির আমদানি হয়েছিল ৫৪ লাখ টন, যার মূল্য ছিল ২৪ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। তবে গত বছর তা চাহিদা অনুযায়ী স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরেছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে গম আমদানি হয়েছে ৭২ লাখ ৪৮ হাজার টন। এজন্য ব্যবসায়ীদের ব্যয় হয়েছে স্থানীয় মুদ্রায় ৩৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকার সমপরিমাণ। সে অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে গম আমদানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ।

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গম আমদানির প্রধানতম উৎস দেশগুলো হলো রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা ও ভারত। এর মধ্যে ইউক্রেন থেকে কম দামের সাধারণ আমিষযুক্ত গম আসে।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৩ সালে গমের আমদানি চাহিদা ও জোগান স্বাভাবিক ছিল না। তবে বিগত বছরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। ২০২৪ সালে দেশের দ্বিতীয় প্রধান এ খাদ্যশস্যের আমদানি বাড়ার পেছনে দুটো বিষয় কাজ করেছে। এর একটি হলো গমের আন্তর্জাতিক বাজার গত বছর পুরোপুরি আমদানিকারকের অনুকূলে ছিল। আবার অন্যদিকে বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে চালের সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিও আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা চিহ্নিত করতে পেরেছেন। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সরবরাহ ঠিক রাখতে আমরা আমদানি হতে পিছু হটিনি। তবে চিনি আমদানি অস্বাভাবিক কম দেখা যাচ্ছে। আবার ২০২৪ সালে বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের চিনি কালোবাজারি হয়ে সীমান্তপথে অবৈধভাবে ঢুকেছে। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় রংপুর, সিলেট, রাজশাহী, ফেনী, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ব্যাপক হারে এসব চিনি দেশে প্রবেশ করেছে।’

খাদ্যপণ্যের জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বিশ্বে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে এখন খাদ্যপণ্য আমদানিতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে ভোজ্যতেল, গম ও চিনির ক্ষেত্রে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পণ্য তিনটি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় এগুলো আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশেরও বেশি। ২০২৩ সালে এ তিন খাদ্যপণ্য আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৫৭ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

ভোগ্যপণ্যের বাজারের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গমের সম্মিলিত আমদানি গত বছর ৭০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্যে অস্থিতিশীলতা না থাকায় আমদানি ও সরবরাহও ভালো হয়েছে। চিনির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আমদানি কম দেখানোর আরেকটি বড় কারণ অবৈধপথে পণ্যটি বিপুল পরিমাণে ঢুকছে বাংলাদেশে। আর ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে আমদানিতে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম সমান হয়ে পড়াটা গোটা বাজারের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

আরও