নরসিংদী জেলা শহরের ভেলানগরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত জেলা কারাগার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে গত বছরের ১৯ জুলাই কয়েক হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে কারাগারটিতে। ওই সময় কারাগার থেকে পালিয়ে যান ৮২৬ বন্দি, যাদের মধ্য নয়জন অতিঝুঁকিপূর্ণ। এরপর তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন সারা দেশে আরো ১৬টি কারাগারে বন্দি বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা ঘটে। তখন বিভিন্ন কারাগার থেকে পালিয়ে যান ২ হাজার ২৩২ জন বন্দি। ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১৭টি কারাগারের সংস্কারকাজ শেষে সেগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে এলেও এখনো ফেরানো যায়নি ঝুঁকিপূর্ণ ৭০ জনসহ পালিয়ে যাওয়া এক-তৃতীয়াংশ বন্দিকে। ফেরারি এসব বন্দির বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। পলাতক বন্দিদের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে কারা অধিদপ্তর।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেশের ১৭টি কারাগারের বন্দিরা বিশৃঙ্খলা-বিদ্রোহ করেন। পালিয়ে যান নরসিংদী, শেরপুর ও সাতক্ষীরা কারাগারের সব বন্দি। নরসিংদী কারাগার থেকে ৮২৬, শেরপুর থেকে ৫০০, সাতক্ষীরা থেকে ৬০০, কুষ্টিয়া কারাগার থেকে ১০৫ ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ২০০ বন্দি পালিয়ে যান। এর বাইরে জামালপুর কারাগারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেখান থেকে বন্দি পালিয়ে যাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। সব মিলিয়ে দেশের কারাগার থেকে সে সময় ২ হাজার ২৩২ জন বন্দি পালিয়ে যান। পরে তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৫০ জন বন্দি ফিরেও আসেন। ফিরে আসা বন্দিদের মধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়া এবং জামিনে মুক্তি মিলিয়ে ১ হাজার ১০০ জন এরই মধ্যে ছাড়া পেয়েছেন। বাকি ৩৫০ জন এখনো কারাগারে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই সর্বপ্রথম নরসিংদী কারাগারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের পর বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সে সময় হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে সেলের তালা ভেঙে দেয়। নিষিদ্ধ সংগঠনের নয়জনসহ মোট ৮২৬ জন বন্দি পালিয়ে যান। এ সময় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে কারা কর্তৃপক্ষ ও রক্ষীরা প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হন। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে কয়েদিদের সঙ্গে মিশে যান তারাও।
দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারকে সর্বাধুনিক নিরাপত্তা প্রস্তুতিসংবলিত কারাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত এ কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, একাধিক গুরুতর অপরাধে জড়িত, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদে জড়িত দুর্ধর্ষ বন্দিদের রাখা হয়। সরকার পতনের পরদিন, ৬ আগস্ট বিকালে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে থাকা বন্দিরা বিদ্রোহ করেন। বিদ্রোহের সময় তারা কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কারারক্ষীরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তাদের ওপর চড়াও হন বন্দিরা। বন্দিদের কেউ দেয়াল ভেঙে, কেউ টপকে, আবার কেউ দেয়ালের সঙ্গে বিদ্যুতের পাইপ লাগিয়ে কারারক্ষীদের মারধর করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীকে খবর দিলে তারা অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করেন। তবে বন্দিদের মধ্যে ২০৯ জন দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পালানোর সময় নিরাপত্তাকর্মীদের গুলিতে মৃত্যু হয় ছয়জনের।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের পর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে জামালপুর কারাগারে। গত ৮ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে কারাগারের কিছু কয়েদি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি শুরু করেন। পরে ১৩ কারারক্ষীকে জিম্মি ও মারধর করে কারাগারের ভেতরের ফটক ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি ছুড়লে নিহত হন ছয়জন। প্রায় ২ ঘণ্টার গোলাগুলিতে কারা কর্মকর্তা ও বন্দিসহ আহত হন ১৯ জন। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় জামালপুর কারাগার থেকে কোনো বন্দি পালিয়ে যেতে পারেননি।
এর আগে ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা কারাগারের প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে কয়েকশ লোক। তারা প্রধান ফটকসহ কারাগারের সব সেলের তালা ভেঙে ৫৯৬ জন বন্দিকে বের করে নিয়ে যায়। পরে সাতক্ষীরা কারাগারের বিভিন্ন শ্রেণীর অনেক বন্দি ফিরে এলেও এখনো পলাতক দুই নারীসহ ৬৭ জন। একই দিন বিকালে শেরপুর জেলা কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সুযোগে কারাগারটি থেকে পালিয়ে যান ৫১৮ বন্দি।
কারা সূত্র জানায়, দেশের সব কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে কারা অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় কারা প্রশাসনেও বেশকিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা ও বন্দিদের সব ধরনের প্রাপ্যতা বিধিবিধান নিশ্চিতেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারাবন্দি ও কর্মচারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারাবন্দি ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কারাগার ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সফটওয়্যারসহ, আরএফ আইডি এবং জিপিএস ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া সেবাপ্রত্যাশীদের সহায়তার জন্য নেয়া হয়েছে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালুর উদ্যোগ। এছাড়া কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তর করতে বন্দিদের প্রশিক্ষণসহ তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এজন্য বিজিএমইএর সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লাইন স্থাপনের কাজ চলছে বলেও জানানো হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন পলাতক বন্দিদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। বন্দিদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ব্যক্তিরা আবার নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন, যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ হতে পারে। অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মী এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়া বন্দিরা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য হুমকি। তারা বিভিন্ন রকম মামলার আসামি ছিলেন। এর ওপর যখন তারা জেল ভেঙে পালিয়েছেন, তখন তারা আরো বেশি দাগি অপরাধী হয়ে উঠেছেন। দেশের চলমান খুন, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধগুলোর পেছনে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জেল পালানো এসব বন্দিকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।’
সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দেশের ১৭টি কারাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছয়টি। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগারগুলো সংস্কার করে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এছাড়া পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে ১ হাজার ৪৫০ জন কারাগারে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ায় মুক্তি পেয়েছেন, অনেকে জামিনেও মুক্তি পেয়েছেন। তবে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে এখনো প্রায় ৭০০ বন্দি ফেরারি। তাদের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবে।’