উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা

বন্যায় অবহেলিত ময়মনসিংহের তিন জেলা, যাননি কোনো উপদেষ্টা

ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বেশ কয়েকটি উপজেলা। এরই মধ্যে নামতে শুরু করেছে সেই পানি। ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। আকস্মিক এ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। পানিতে তলিয়ে গেছে লক্ষাধিক হেক্টর জমির আমন ধান, পচে গেছে সবজিখেতের ফসল। ভেসে গেছে খামারের মাছ। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রচুর ঘরবাড়ি। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে প্লাবিত গ্রামগুলোর অধিকাংশ সড়ক। দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকটও। বন্যায় এ অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সরকারের কোনো উপদেষ্টা পরিদর্শনে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বন্যার্তরা। প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা অবশ্য দাবি করেন, সবার কাছেই ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। তবে যোগাযোগ সমস্যার কারণে কিছু এলাকায় যেতে সমস্যা হচ্ছে।

পুকুর ভাড়া নিয়ে মাছের খামার করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই ছিল ব্যাংক ঋণ। আশ্বিনের বৃষ্টি আর উজানি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় মুহূর্তের মধ্যেই ভেসে গেছে তার সব মাছ। ঋণ শোধ আর সংসারের খরচ এখন কীভাবে চালাবেন, তা নিয়েই আছেন চরম দুশ্চিন্তায়। আনোয়ার হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দার আমতৈল গ্রামে। আকস্মিক বন্যায় ২৫ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন এ মৎস্যচাষী। তার মতো অনেক পরিবারই ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বন্যার পানি কমায় সে ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় নদ-নদীর পানি কমায় এবং নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে পানি কমলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। এখনো পানির নিচে নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রাম। ময়মনসিংহের সীমান্ত উপজেলা হালুয়াঘাটের কৈচাপুর ইউনিয়নের মোফাজ্জল হোসেন। পানির তোড়ে তছনছ হয়ে যায় তার মাটির ঘরটি। পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে পার করছেন দিন। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাননি বলে জানান।

ত্রাণ না আসায় নিজেদের কষ্টের কথা তুলে ধরে বন্যার্তরা জানান, শুধু শুকনো খাবার খেয়ে সপ্তাহ পার করেছেন এমন অনেকেই রয়েছেন। অথচ ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে হয়ে যাওয়া বন্যায় প্রায় সব উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী নেতারা পরিদর্শন করেছেন। দেয়া হয়েছে বিপুল ত্রাণ সহায়তাও। আর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বলার মতো কেবল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব মো. সাইফুল্লাহ পান্না বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে তিনি হালুয়াঘাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন এবং বিলডোরার রহেলা এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে মতবিনিময় ও কিছু ত্রাণ বিতরণ করেন। এছাড়া গতকাল শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান।

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের সচিব, মহাপরিচালক ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব এসেছিলেন। তাদের কাছে সবশেষ তথ্য পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই বন্যার আপডেট দিচ্ছি।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বন্যায় শেরপুর সদর উপজেলা, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী, নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। বানের জলে ভেসে গেছে ছয় হাজার পুকুরের মাছ। পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। বন্যায় সীমান্ত এ জেলায় মৃত্যু হয়েছে আটজনের। এখনো পানিবন্দি আছেন অনেকেই। বিধ্বস্ত হওয়া কয়েকশ ঘরবাড়ির বাসিন্দাদের ঠাঁই হয়েছে রাস্তার ধারে, স্বজনদের বাড়িতে কিংবা আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। সরিয়ে নেয়া হয়েছে গবাদিপশু। তুলনামূলক উঁচু অঞ্চলের পানি নেমে বর্তমানে গেলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হওয়ায় অনেক এলাকায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে রয়েছেন তারা। সেনাবাহিনী, র‍্যাবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা শুকনো খাবারসহ অন্যান্য জরুরি সামগ্রী বিতরণ করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আবার সব জায়গায় এসব ত্রাণসামগ্রী সময়মতো পৌঁছাচ্ছেও না। ফলে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই। পাঠদান বন্ধ রয়েছে জেলার বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে, সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের আটভাইপাড়া গ্রামের অনেক বাড়ি বন্যায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর একজন রুবেল হাসান, তার ঘর ছিল দুটি, দুটিই ভেঙে গেছে। ঘরের সব মালপত্র ভেসে গেছে পানিতে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু রাস্তায়। তার মতো অনেকের ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে উজান থেকে নেমে আসা পানি।

বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ বেশ দুর্ভোগে রয়েছে জানিয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) তরফদার মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছে। প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়কে অবগত করা হচ্ছে, আপডেট দেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট, সাড়ে ১২ হাজার প্যাকেট রান্না করা খাবার দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পুলিশ বাহিনী, র‍্যাব, বিজিবির পক্ষ থেকেও ত্রাণ তৎপরতা চালানো হচ্ছে।’

ভারি বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার পাঁচ উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। বন্যাকবলিতদের জন্য খোলা হয় আশ্রয় কেন্দ্র। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও সদর উপজেলায়। সদরের ৯৬৩টি ও কলমাকান্দায় ৩২২টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেকে। পানির নিচে ডুবে আছে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ধানের খেত। জেলার সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, ৬৫০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ডুবে যায় বন্যার পানিতে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে পানি কমলেও বাসিন্দাদের সংকট ও দুর্ভোগ এখনো কাটেনি। দুর্গত ব্যক্তিরা বাড়িঘরে ফিরলেও অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার করতে পারছে না। অনেক গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানির নিচে থাকায় প্রয়োজনীয় যোগাযোগেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। বন্যার কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয় ২৩৫টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

নেত্রকোনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন জানান, বন্যার কারণে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পানি ঢুকে পড়ায় চার উপজেলায় ১৮৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরো একটি উপজেলায় ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেগুলো খুলে দেয়া হবে।

বৃষ্টি ও ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় জেলার পাঁচ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে বলে জানান নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বন্যাকবলিত গ্রামের অনেক পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। পানিবন্দি মানুষের মাঝে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে।’

আর কোনো ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ময়মনসিংহের ফুলপুর, হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায়ও বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। প্রায় সব এলাকায়ই খাবার ও বিশুদ্ধ পানির বেশ সংকট। তবে বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোয় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে রোপা আমনের। জেলা কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, তিন উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন ধানের খেত নষ্ট হয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি রোপা আমনের জমি নষ্ট হয়েছে ধোবাউড়া উপজেলায় ১০ হাজার ৫৬০ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪৩ হাজার ২৫০ কৃষক। ১০ হাজার ৩১০ হেক্টর আমনের জমি নষ্ট হয়েছে হালুয়াঘাটে। এ উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২৫ হাজার ২৭৫ কৃষক। ফুলপুরে নষ্ট হয়েছে ৩ হাজার ৪০৫ হেক্টর জমি, ১৫ হাজার ৬০০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এবার ধানের আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন জানিয়ে হালুয়াঘাটের কৃষক বাবুল হোসেন বলেন, ‘আমার ধানখেতে এখনো গলা সমান পানি। হাত দিয়ে ধরলেই ধানগাছগুলো উঠে যাচ্ছে। গোড়া থেকে সব গাছ পচে গেছে। তাই পানি নেমে গেলেও ধান পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই এবার।’ তার এলাকার প্রায় সব ধানি জমিই এখন পানির নিচে বলে জানান এ কৃষক।

ময়মনসিংহের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে জানিয়ে জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এবারের বন্যায় প্রায় দুই লাখ মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন। পানি ঢুকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত হয়েছে। তবে কংস ও নেতাই নদীর পানি কমছে। ফলে বাড়িঘরে ওঠা পানি দ্রুতই নেমে যাচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকেও বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে দুর্গত এলাকার মানুষ।’

এদিকে বন্যার কারণে জেলার তিন উপজেলায় ৩৫৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান জানান, হালুয়াঘাটে ১৬৫টি, ধোবাউড়ায় ৯০, ফুলপুরে ১৯ বিদ্যালয়সহ তিন উপজেলায় ২৭৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করে। এর মধ্যে ৬৩টি বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। সেগুলোয় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। যদিও দুর্গা পূজা উপলক্ষে এখন সারা দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

ত্রাণের কোনো অভাব নেই জানিয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যদি কেউ এসব বলে তা গুজব। এ পর্যন্ত দুই হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিদিন ১ হাজার ৩০০ প্যাকেট রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। বন্যার পানি সব উপজেলায় কমে গেছে। পানি নেমে গেলে ক্ষতি হিসাব করে সরকারের সহায়তা পৌঁছে দেয়া হবে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নেত্রকোনা প্রতিনিধি ভজন দাস)

আরও