দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে সরব হওয়ার প্রয়াস চালিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। যদিও তেমন একটা আলোড়ন তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জামায়াত-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নিজের রাজনীতি ধরে রাখতে দলটিকে এখন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়াস চালাতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের সঙ্গে নতুন করে কোনো সংঘাতে যেতে চাচ্ছেন না জামায়াত নেতারা।
দুই-তিন দশক আগেও দেশের রাজনীতিতে বড় প্রভাবকের ভূমিকায় ছিল ‘জামায়াত ফ্যাক্টর’। জোটবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে একসময় সরকারের অংশও হয়েছে দলটি। এমনকি ক্ষমতার বাইরে থেকেও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে বিভিন্ন সময়ে। তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি, অর্থনৈতিক শক্তি হ্রাস ও সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে গত দশকে এক প্রকার পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে দলটি।
রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের রাজনীতির বড় বাধা এখন দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি। চলমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দলটির আদর্শ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশ না, বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য স্থানেও জামায়াতের রাজনীতি এখন ধুঁকছে। এমনকি পাকিস্তানেও সর্বশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলটির ব্যাপক ভরাডুবি ঘটেছে। সামনের দিনগুলোয়ও দলটির তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারার সম্ভাবনা কম।
এ বিষয়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এ দেশে আর কোনো রাজনীতি নেই। মানুষ এখন খেতে পারছে না। এখানে চিকিৎসা নেই। পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। নানা রকম বৈদেশিক রাজনীতির প্রভাব এখানে পড়ছে। এখানকার ইস্যু এগুলোই। এসব নিয়েই রাজনীতি হবে। তবে এখনো ধর্মের কথা বলে কিছু লোকের মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছে জামায়াত। কিন্তু দেখা গেল যে এরা ভোট পায় না। এমনকি তারা পাকিস্তানেও ভোট পায় না। ফলে জামায়াতে ইসলামী যে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতা দখলে যাবে এর কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ দেশে রাজনীতি করে কখনো দলটি সুবিধা করতে পারবে না।’
জামায়াতের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪১ সালে মাওলানা মওদুদীর হাতে লাহোরে। পরে বাংলাদেশ ও ভারতেও দলটির কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। ভারতে দলটি কখনই তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হলেও দলটি রাজনীতিতে ফেরে আশির দশকে। ওই দশকেই পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হকের জান্তা সরকারের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিল জামায়াত।
বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে দলটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে জামায়াত। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম শরিক হয় জামায়াত। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতায় আসীন হয় দলটি। তবে জামায়াতের প্রভাবে ভাটা পড়তে দেখা যায় গত দশকের শুরুতে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সাল থেকে কয়েক বছরের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বেশকিছু নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে জামায়াতে ইসলামী।
দলটির অর্থনৈতিক শক্তিকে পর্যুদস্ত করে তোলে মীর কাসেম আলীর মৃত্যু। তাকে বলা হতো দলটির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। জামায়াতের তহবিলের বড় একটি অংশের জোগান আসত মীর কাসেম আলীর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। তার গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ডের পর জামায়াত ঘরানার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় বন্ধ বা হাতছাড়া হয়ে পড়েছে। ভঙ্গুর হয়েছে দলটির আর্থিক সক্ষমতাও।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী অন্যতম পুরনো একটি দল হওয়া সত্ত্বেও কখনো এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। কখনো কখনো ক্ষমতার অংশ হয়েছিল। দলটি তাদের যে আদর্শিক জায়গাগুলোর কথা বলে যেমন সুদ পরিহার করা, রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীদের অংশ না নেয়া সেগুলো তো সম্ভব না। তারা যে ব্যাংকের কথা বলছে সেখানেই তো সুদের ব্যবস্থা আছে অন্য নামে। অর্থাৎ তারা যে আদর্শের কথা বলে সেগুলো আগেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, এখনো সম্ভব না। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। এসব কিছুর প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে দলটির অবস্থা ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। এখানে অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে দলটি।’
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান অবস্থার কারণ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা তাদের জন্য বড় একটি বাধা হয়ে আছে। এছাড়া তারা যখন ২০০১ সালে ক্ষমতায় এল, তখন বাংলা ভাইয়ের উত্থানের ঘটনায় তাদের অবস্থানটিকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা তাদেরই একটি অংশ ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে যখন যুদ্ধাপরাধের জন্য তাদের শীর্ষ বেশ কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হলো, তখনই তাদের পতন ঘটেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার মতো বিষয়। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতকে পাশে রাখায় বিএনপি সমালোচিত হয়েছে। অবশেষে বিএনপির সমর্থনও হারায় দলটি। তাদের অনেক বুদ্ধিজীবী দল ত্যাগ করেছে, যাদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক অন্যতম। তরুণদের একটি অংশ অন্য দল গঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এতে নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে দলটি।’
যদিও জামায়াতের নেতারা দাবি করছেন, তাদের দল এখনো আগের মতো শক্তিশালী অবস্থায় আছে। বিগত বছরগুলোয় দলটি তাদের নানা কার্যক্রম চালু রেখেছে। নিজেদের সংগঠিত করেছে। এখনো তাদের অস্তিত্ব তেমন কোনো সংকটে পড়েনি।
জামায়াতে ইসলামীর চলমান রাজনীতি নিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক এবং দলের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১০ সাল থেকেই জামায়াতের ওপর নানাভাবে জুলুম-নির্যাতন করছে ক্ষমতাসীন সরকার। সেই ধারা এখনো বজায় রেখেছে। কোথাও বৈঠক করলে সেখান থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও তারা জামায়াতকে দমাতে পারেনি। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কাজ করে চলেছি। জনশক্তি রিক্রুটসহ সবকিছু চলমান রয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি না মানলে কাজ করতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার সভা-সমাবেশের মতো অধিকারগুলোয় বাধা দেয়ায় আমরা আগের মতো রাজপথের রাজনীতি সবসময় চালু রাখতে পারি না। কেননা রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাই না। সরকারের জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে অতীতে যেমন কোনো প্রভাব পড়েনি, সামনের দিনেও পড়বে না বলে আমি মনে করি।’
উৎপত্তিস্থল পাকিস্তানেও এখন একপ্রকার প্রভাবহীন জামায়াত-ই-ইসলাম। দেশটির সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে পাকিস্তান জামাতের প্রধান সিরাজুল হক হেরেছেন ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত এক প্রার্থীর কাছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে দলের আমিরের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন সিরাজুল হক।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর সুবাদে রাজনীতিতে আসে জামায়াতে ইসলামী। পরে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের নিবন্ধনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে আবেদন করেছিল। ২০০৯ সালের করা সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে নিবন্ধন হারায় দলটি। এর বিপরীতে জামায়াতের আপিল নাকচ হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতেও।
দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় পর গত বছরের জুনে ঢাকায় প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশ করে দলটি। সে সময় দলটির পক্ষ থেকে নিবন্ধন ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সভা-সমাবেশ করছে—বিষয়টি দেখিয়ে আবেদন করা হয়েছিল। দলটি সে সময় অনুমতিও পেয়ে যায়। এরপর কিছুদিন মাঠে সরব ছিল দলটি। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের কিছু কর্মসূচিতে সমর্থনও জানিয়েছিল। যদিও সেসব আন্দোলনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি জামায়াত।
জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিএনপি তার নিজের কর্মসূচি অনুযায়ী এগোচ্ছে। আমাদের চলমান আন্দোলনের সঙ্গে যারাই একাত্মতা প্রকাশ করেছে, তারাও তাদের মতো আন্দোলন চালিয়ে গেছে। যেমনটি জামায়াতে ইসলামীর বেলায়ও হয়েছে। তবে জামায়াতের চিন্তা তারা নিজেরাই বলতে পারবে।’
জামায়াতে ইসলামী এখন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এগোচ্ছে বলে মনে করছেন কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শুধু ক্ষমতাসীনরা নয়, তারা এতদিন যাদের সঙ্গে তাদের রাজনীতি মেলে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করছে। দ্বিদলীয় রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সর্বশেষ গত বছর ২৮ অক্টোবর তারা তাদের নিজস্ব শক্তি দেখিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে গেল। তারা একদিকে সরকারের প্রশ্রয় নিল। একই সঙ্গে যাদের সঙ্গে তাদের রাজনীতি মেলে, তাদের পক্ষেও অবস্থান নিল। রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য তারা সবকিছুই করে যাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের মানুষকে দুই দলের বাইরে বিকল্প কোনো পথ দেখাতে না পারছি, ততদিন দলটি টিকে থাকবে।’