অনিরাপদ পানি ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পাথরঘাটার মানুষ

বরগুনার পাথরঘাটা উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় তিন লাখ মানুষের বাস। নিরাপদ পানির দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে তাদের সবাইকে নির্ভর করতে হয় পুকুর, নদী ও নলকূপের ওপর।

বরগুনার পাথরঘাটা উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় তিন লাখ মানুষের বাস। নিরাপদ পানির দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে তাদের সবাইকে নির্ভর করতে হয় পুকুর, নদী নলকূপের ওপর। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পুকুর অন্যান্য জলাধারগুলোয় লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে পুকুরের লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে অঞ্চলের মানুষের। অপরিশোধিত পানি পান করার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে ক্লোরাইডের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রামের (এমজি) নিচে হলে তা মোটামুটি বিশুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ক্লোরাইডের মাত্রা প্রতি লিটারে ৩০০-৬০০ মিলিগ্রাম হলে তা পান করার যোগ্য বলেও ধরে নেয়া হয়। প্রাকৃতিকভাবে পানিতে ক্লোরাইডের মাত্রা বেশি হলে সোডিয়ামের মাত্রাও বেশি হয়। মানব শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হলো উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি। লবণাক্ত পানি পান করার কারণে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। এছাড়া পুকুরের পানিতে রোগজীবাণু থাকে। পরিশোধন না করে সে পানি পান করলে ডায়রিয়া, আমাশয়, ক্ষুধামান্দ্য চর্মরোগসহ মানবদেহে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটির নিচে পাথরের মতো শক্ত বস্তু থাকায় নলকূপ স্থাপন করা যাচ্ছে না। উপজেলার প্রায় ২৫-৩০টি এলাকায় নিরাপদ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এছাড়া ১৫-২০টি এলাকায় রয়েছে মাঝারি সংকট। মানবদেহের জন্য সহনীয় লবণের মাত্রা ৬০০ পিপিএম হলেও পাথরঘাটার ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের মাত্রা রয়েছে প্রায় হাজার পিপিএম পর্যন্ত। গভীর নলকূপ বসালেও লবণাক্ততার কারণে সেগুলো কোনো কাজেই আসছে না। এছাড়া কিছু অঞ্চলে কাদাযুক্ত পানি ওঠায় কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাথরঘাটা উপজেলায় ৮৬টি নলকূপ, ৬৮টি সোলার পিএসএফসহ হাজার ৫২০টি পানির ট্যাংক ২০২৫ সালের মধ্যে বিতরণ করার কথা। এছাড়া খনন করা হয়েছে ৪৮টি পুকুর। তার পরও পানির সংকট কাটছে না।

ব্যাপারে বরগুনা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাইসুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বরগুনার ছয়টি উপজেলার মধ্যে পাথরঘাটার ভৌগোলিক অবস্থান একটু বিচিত্র। এখানকার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ পাথারঘাটা সদরেও গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না। আমরা পরীক্ষামূলক কিছু নলকূপ স্থাপন করেছি। দেখা গেছে, হাজার ২০০ থেকে হাজার ৩০০ ফুট গভীরে যাওয়ার পরও পানির ভালো স্তর পাওয়া যায়নি। কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এগুলো পর্যাপ্ত নয়। এজন্য পুকুর খনন পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহারের পাশাপাশি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পাথরঘাটায় নিরাপদ পানির দীর্ঘদিনের সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।

সরজমিনে দেখা গেছে, পৌরসভার ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে পানির কিছু ফিল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। একদিকে চাহিদার তুলনায় ফিল্টার কম, অন্যদিকে কাছাকাছি পানির ব্যবস্থা না থাকায় মেপে পানি পান করতে হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের।

পাথরঘাটার বাদুরতলায় বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন একটি ফিল্টার স্থাপন করেছে। তবে পানির গ্রাহক কয়েক হাজার মানুষ। ৩০ টাকা দিয়ে একটি পরিবার ১৫ দিন পানি নিতে পারে দুই কলস করে।

ফিল্টার থেকে পানি নিতে আসা রাব্বি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় নলকূপ স্থাপন করা যায় না। যদি কেউ করে, তাহলে তা দিয়ে লবণ পানি ওঠে, পান করা যায় না। চরাঞ্চলে অনেকগুলো পরিবারের পানির জন্য মাত্র একটি ফিল্টার। এর সঙ্গে সংযোগ দেয়া পুকুরটিও ছোট হওয়ায় অনেক সময় শুকনো মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না।

শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘উপকূলের মানুষের পানির দুঃখ ১২ মাস। প্রকৃতিগতভাবে এখানে পানি আছে ঠিকই, কিন্তু নিরাপদ পানি নেই। তাই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি বেসরকারিভাবে পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংক দেয়া হচ্ছে। যেহেতু বিষখালী বলেশ্বর নদ রয়েছে, তাই পুকুর, খাল নদী থেকে ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধনাগারের মাধ্যমে রিফাইন করে সরবরাহ করলে সংকট স্থায়ীভাবে দূর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের নতুন পরিকল্পনা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

লবণাক্ত পানি পানের মাধ্যমে অতিরিক্ত সোডিয়াম ক্লোরাইড গ্রহণ করছেন অঞ্চলের মানুষ, যা তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। লবণাক্ত পানি পানের কারণে গর্ভবতী নারীদের কিডনি যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিষয়ে বরগুনা সিভিল সার্জন ডা. প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চল পাথরঘাটার বেশির ভাগ পানিই লবণাক্ত। অনাবৃষ্টির কারণে পানি দূষণ হচ্ছে। অঞ্চলের মানুষ পুকুরের পানি পান করে। তবে গ্রীষ্মকালে পুকুরগুলো শুকিয়ে যায়। যেসব পুকুরে পানি থাকে, তা অপরিচ্ছন্ন। এসব জলাশয়ের পানি পানের অনুপযোগী। ফলে গরমে ডায়রিয়া কলেরাসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে অঞ্চলের মানুষের।

আরও