কাগজে-কলমে এ মুহূর্তে দেশের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে ১১২ কোটি ৫১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের এ উল্লম্ফন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তবে এ প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারছিলেন না সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টিতে বিস্মিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীরাও। তাদের ভাষ্য ছিল, দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা এখনো জীবনধারণের ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় বৈধ আয় থেকে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকও।
তবে বণিক বার্তার অনুসন্ধান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের বড় অংশই দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের পাঠানো নয়। বরং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশীর পাঠানো রেমিট্যান্সও যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে দেখানো হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের পাঠানো অর্থও যুক্তরাষ্ট্রের রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশে ঢুকছে। মূলত বাংলাদেশী রেমিট্যান্সের বাজার থেকে মাস্টারকার্ড, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ মার্কিন বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ ও অ্যাগ্রিগেটরের (যেসব বড় প্রতিষ্ঠান অন্যান্য ছোট এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে রেমিট্যান্স বা আন্তঃদেশীয় লেনদেনের অর্থ সংগ্রহ করে একত্র করে) সংগৃহীত রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে দেখানোর কারণেই পরিসংখ্যানে বড় ধরনের গড়বড় দেখা দিয়েছে।
একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বাংলাদেশে আসা রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে দুবাইভিত্তিক অ্যাগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠান ইনস্ট্যান্ট ক্যাশ। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশটি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০২ কোটি ৭২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এখানেও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রকৃতের চেয়ে বেশি দেখানো হচ্ছে বলে সন্দেহ ব্যাংকারদের। তাদের ভাষ্যমতে, দেশের রেমিট্যান্সের বাজারে এখন আধিপত্য করছে হাতেগোনা কয়েকটি অ্যাগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠান। এর মধ্য দিয়ে রেমিট্যান্সের বাজারে এখন আর প্রতিযোগিতামূলক নেই। বরং এর বদলে তা রূপ নিয়েছে অলিগোপলিতে।
একটি বাজারের নিয়ন্ত্রণ হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেলে অর্থনীতির পরিভাষায় সেটিকে বলা হয় অলিগোপলি। এ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারে মূল্যকেও প্রভাবিত করার ক্ষমতা তৈরি হয়। একই সঙ্গে বাজারের পরিস্থিতিও অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রতিযোগী ও ভোক্তাদের জন্যও ক্রমেই প্রতিকূল হয়ে উঠতে থাকে।
বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের বাজারে এখন অনেকটা এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ব্যাংকার ও স্থানীয় মানি এক্সচেঞ্জগুলোর নির্বাহীরা বলছেন, আগে রেমিট্যান্সের বাজার ছিল ছোট ছোট মানি এক্সচেঞ্জনির্ভর। এসব মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংক রেমিট্যান্স সংগ্রহ করত। কিন্তু এখন রেমিট্যান্সের বাজার অ্যাগ্রিগেটর-নির্ভর হয়ে উঠেছে। ছোট মানি এক্সচেঞ্জগুলো ব্যাংকের কাছে রেমিট্যান্স বিক্রি না করে অ্যাগ্রিগেটরদের দিচ্ছে। তারা সংগৃহীত রেমিট্যান্স দরকষাকষি করে বেশি মূল্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করছে। মূলত এ কারণেই এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউএই থেকে রেমিট্যান্স বেশি দেখাচ্ছে। আর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে শ্লথ হয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স বেশি দেখানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা মাস্টারকার্ডের। ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড নেটওয়ার্কের জন্য বিখ্যাত এ মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি এখন বৈশ্বিক রেমিট্যান্সের বাজারেরও জায়ান্ট হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালে মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ট্রান্সফার্স্ট অধিগ্রহণ করার মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বাজারে প্রবেশ করে মাস্টারকার্ড। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির আন্তঃদেশীয় রেমিট্যান্স ব্যবসা দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে। মাস্টারকার্ড বর্তমানে বিশ্বের ২১০টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে সরাসরি রেমিট্যান্সের অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি এখন অ্যাগ্রিগেটর হিসেবেও ভূমিকা রাখছে। আর গত কয়েক বছরে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার বড় মাধ্যমও হয়ে উঠেছে। দেশের রেমিট্যান্সের বাজারে মাস্টারকার্ডের বাজার অংশীদারত্ব যত বাড়ছে, ঠিক ততটাই উল্লম্ফন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সে।
বাংলাদেশে মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, তার উৎস নিয়ে আমাদের মধ্যেও প্রশ্ন আছে। আমরা দেখছি, মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের মতো দেশগুলোয় মিলিয়ন মিলিয়ন বাংলাদেশী থাকার পরও সেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। আমার ধারণা, মাস্টারকার্ড, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ আমেরিকান মানি এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে দেখানো হচ্ছে। এর কারণে রেমিট্যান্সের উৎস দেশগুলোর বিষয়ে ভুল তথ্যও যাচ্ছে। মাস্টারকার্ড এখন বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের বাজারের সবচেয়ে বড় অংশীদার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ১ হাজার ৭৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে গড় এ প্রবৃদ্ধির চেয়েও কয়েক গুণ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৪৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ছয় মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০২ কোটি ৭২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এক্ষেত্রে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে মাত্র ১৭২ কোটি ৩১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাস্টারকার্ড রেমিট্যান্সের বাজারে আসার বছর তথা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮৪ কোটি ডলার। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্স দেখানো হয় ২৪০ কোটি ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে এ রেমিট্যান্স বেড়ে ৩৪৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্স দেখানো হয় যথাক্রমে ৩৪৪ কোটি ও ৩৫২ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি কিছুটা কমলেও দেশটি থেকে ২৯৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আর সর্বশেষ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৪৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বলে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক অর্থবছরে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসত, এখন ছয় মাসেই তার চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে।
যদিও শ্রমশক্তির বিচারে দেশের সবচেয়ে বড় বাজার হলো সৌদি আরব। কেবল ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসেই ৫ লাখ ৪১ হাজারের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি আরব গেছেন, যা গত বছর মোট অভিবাসী শ্রমিকের প্রায় ৬০ শতাংশ। আর ২০২১ থেকে ২০২৪-এ চার বছরে দেশ থেকে সৌদি আরব গেছেন ২১ লাখ ৯ হাজার বাংলাদেশী।
এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী নতুন করে সৌদি অভিবাসী হলেও এ সময়ে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫৭২ কোটি ডলার। কিন্তু এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি কমে ৪৫৪ কোটিতে নেমে আসে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩৭৬ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্স আরো কমে ২৭৪ কোটি ডলারে নেমে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী থাকলেও সেখানে তাদের আয় সন্তোষজনক নয়। আবার অনেক বাংলাদেশী শ্রমিক বেকার বসে আছেন। দেশে ফেরার মতো আর্থিক সামর্থ্যও অনেক শ্রমিকের নেই। তবে দেশটি থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেখানো হচ্ছে, সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। মাস্টারকার্ডসহ মার্কিন বড় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে দরকষাকষি করে তারা বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। এ কারণে সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশের অনেক রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে চলে যাচ্ছে।
একই ধরনের বক্তব্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানেরও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্সের বাজার এখন অ্যাগ্রিগেটররা নিয়ন্ত্রণ করে। এর বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রেমিট্যান্স এত বেশি দেখাচ্ছে। অ্যাগ্রিগেটরদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উৎস দেশ নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন। ’
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রথম সারির একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের বাজার এখন মাস্টারকার্ডের নিয়ন্ত্রণে। কোনো ব্যাংকের যদি ১০ মিলিয়ন ডলারও প্রয়োজন হয়, তাহলে মাস্টারকার্ড সেটি ১০ মিনিটের মধ্যে সরবরাহ করতে সক্ষম। তবে এক্ষেত্রে তাদের দেয়া বিনিময় হারে ডলার নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের পক্ষে দরকষাকষি করার কোনো সুযোগ থাকে না। ব্যাংকগুলোর বেশি দরে ডলার না কিনলে মাস্টারকার্ডসহ বড় অ্যাগ্রিগেটররা তা ধরে রাখে। সংকটে পড়লে ব্যাংক তখন বেশি দর দিয়ে হলেও ডলার কিনতে বাধ্য হয়।’
রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোর জন্য প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ১২২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোনো ব্যাংক এ দরের বেশি দিয়ে ডলার কিনলে সে ব্যাংকে নিরীক্ষা দল পাঠিয়ে জরিমানা করা বা সতর্ক বার্তা দেয়া হচ্ছে। দর নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে গত সপ্তাহের চার কর্মদিবসে মাস্টারকার্ড থেকে রেমিট্যান্স কিনতে নিষেধ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মৌখিক নির্দেশের কারণে দেশের প্রথম সারির ব্যাংকগুলো ওই চারদিন মাস্টারকার্ড থেকে রেমিট্যান্স কেনেনি বলে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষনির্বাহী ও ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বণিক বার্তাকে জনিয়েছেন।
তবে ডলারের দরে অস্থিরতার পেছনে মাস্টারকার্ডের ভূমিকা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমরা সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করছি। এ শ্রেণীর ব্যাংকগুলো সাধারণত বাড়তি দরে রেমিট্যান্স কেনে না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে আসে। আমরা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির পর্যায়ে পাঠানো রেমিট্যান্সও আনি। আবার অন্য মানি এক্সচেঞ্জের সংগ্রহ করা বড় অংকের রেমিট্যান্সও আনি। ’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের ২১০টি দেশে মাস্টারকার্ডের ব্যবসা রয়েছে। এমন অনেক দেশ আছে, যেখান থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য বিকল্প কোনো মাধ্যম নেই। এ কারণে সেখান থেকে মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসছে। আবার কিছু দেশের ছো্ট মানি এক্সচেঞ্জগুলো রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে আমাদের মতো বৈশ্বিক জায়েন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠায়। শুধু আমরাই নই, বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানই এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।’
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে ২০২৪ সালের শেষ মাস তথা ডিসেম্বরে। ওই মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২৬৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। তবে জানুয়ারিতে এসে এ রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা কমে গেছে। গত মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
ডলারের দর নিয়ে চাপ থাকার কারণেই গত মাসে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে বলে একাধিক ব্যাংক নির্বাহী অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করার কারণে জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স কমে গেছে। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। সামনে রোজা আসছে। রমজানে প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। এখন দর নিয়ে চাপাচাপি করলে রেমিট্যান্স হুন্ডির বাজারে চলে যাবে। বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসত। অর্থনীতির স্বার্থেই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা দরকার।’
রেমিট্যান্সের উৎস দেশের তথ্যে বিভ্রান্তির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত কয়েক মাস আগে বিষয়টি আমারও নজরে এসেছে। তখন আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলাম। কিন্তু তারা কোনো কিছু করেছে বলে মনে হয় না। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে মার্কিন ও আরব আমিরাতভিত্তিক অ্যাগ্রিগেটরদের আধিপত্য বাড়ায় দেশ দুটি থেকে রেমিট্যান্স বেশি দেখাচ্ছে। অথচ বাস্তব পরিস্থিতি সেটি নয়। তথ্যের এ অসামঞ্জস্য দূর করার উদ্যোগ নেয়া দরকার।’