পটুয়াখালীর পায়রাকে সমুদ্রের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছিল পতিত বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বলা হয়েছিল, পায়রাকে দেশের লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এজন্য সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়। তবে গভীরতা না মেলায় ২০২১ সালে পায়রাকে গভীর সমুদ্রবন্দর করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পায়রায় সমুদ্র বা নদীবন্দর নয়; বরং একটি ঘাট হতে পারত। বিপুল বিনিয়োগ ও ব্যয়ের পর এখন প্রকল্পটি থেকে সরে আসাও যাচ্ছে না। এ কারণে পায়রা বন্দর প্রকল্পকে অর্থনীতির জন্য বিষফোঁড়া বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরগুলোয় কমপক্ষে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নোঙর করে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ প্রাধান্য পাচ্ছে অনেক বন্দরে। যদিও এ ধরনের জাহাজ চলাচলের জন্য যে গভীরতা প্রয়োজন তা নেই বাংলাদেশের কোনো সমুদ্রবন্দরেরই। এ অঞ্চলের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর সিঙ্গাপুরের গভীরতা ২৪ দশমিক ৫ মিটার, যার ধারেকাছেও নেই পায়রা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা নদীবন্দরটি যেখানে অবস্থিত, সেখান দিয়ে প্রতি বছর উজান থেকে আসা বিপুল পরিমাণ পলি প্রবাহিত হয়। নিয়মিত ড্রেজিং ছাড়া বন্দরটি চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে, তা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকারের দাবি ছিল, চালু হওয়ার পর বন্দরের আয় দিয়েই ব্যয়বহুল ড্রেজিং কার্যক্রমসহ অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। সে চিন্তা থেকে তৎকালীন সরকার চরম ডলার সংকটের মধ্যেও পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ড্রেজিংয়ের জন্য রিজার্ভ ভেঙে অর্থ পরিশোধ করে।
পায়রা বন্দরে আনুষ্ঠানিক পণ্য খালাস কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালের আগস্টে। তবে বেশি গভীরতার জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে ২০১৯ সালের শুরুতে বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেলজিয়ামভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জান ডি নুল এনভির মধ্যে চুক্তি হয়। ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ১০ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। এ চ্যানেল দিয়ে ৪০ হাজার টন সক্ষমতার জাহাজ পায়রা বন্দর ব্যবহার করতে পারার কথা বলা হয়। এরই মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে।
বন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেটিতে বড় জাহাজ চলাচলের জন্য রাবনাবাদ চ্যানেলের গভীরতা গত বছর সাড়ে ১০ মিটারে উন্নীত করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় জাহাজ চলাচলের জন্য চ্যানেলে কমপক্ষে ৮ দশমিক ৭ মিটার গভীরতা প্রয়োজন। কিন্তু এখন জোয়ার-ভাটাভেদে চ্যানেলের গভীরতা সাড়ে ৬ থেকে ৫ দশমিক ৯ মিটারে নেমে আসছে। গত মাসেও চ্যানেলটির সর্বোচ্চ গভীরতা ছিল ৬ দশমিক ৯ মিটার।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, রাবনাবাদ চ্যানেল খনন ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। এতে খরচ হয় ৬ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খনন ও রক্ষণাবেক্ষণকাজে খরচ হয় ৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। গত বছরের এপ্রিলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও জরুরিভাবে কাজ চলে গত আগস্ট পর্যন্ত। এর পর থেকে খননকাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
আর বন্দরের প্রথম টার্মিনাল বন্দর নির্মাণে ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকায় আরেকটি প্রকল্প শুরু করা হলেও তা ২০২১ সালের মধ্যে শেষ হয়নি। বরং প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। আর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকায়। গতকাল একনেক সভায় প্রকল্পটির ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি অনুমোদন করা হয়। নতুন করে ৯১১ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে।
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ প্রায় ৭২ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। তাই প্রকল্পটি বাদ দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা এটা শুরু করতাম না। এখানে বড় জাহাজ আসতে পারে না। এটা নদীবন্দরও না, বড়জোর একটা ঘাট হতে পারত।’
এখন প্রকল্পটি বন্ধ করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকায় প্রকল্পটি বাদ দেয়া যাচ্ছে না। সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে গিয়ে সুন্দরবনের একটি অংশ নষ্ট হয়েছে। এখন আবার ইয়ার্ড, জেটি ও সংযোগ সড়ক করা লাগবে। এভাবে চলতেই থাকবে। ব্যয়বহুল ড্রেজিং মেশিন কেনা হচ্ছে। সারা বছর ড্রেজিং করতে হবে। এখন এটার কোনো উত্তম সমাধান নেই। এটা অর্থনীতির জন্য বিষফোঁড়ার মতো। অনেক বিনিয়োগ করে সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে, চাইলেই সেটা বন্ধ করা যাবে না।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা নদীতীরে কয়লাভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থান। আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি উৎপাদনে রয়েছে, একটি উৎপাদনের অপেক্ষায় ও আরেকটি নির্মাণাধীন।
চ্যানেলের গভীরতা নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে পায়রায় নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য, বড় জাহাজ চলাচল করতে না পারলে এ বন্দর বাণিজ্যিকভাবে কখনো লাভজনক হবে না। আবার পায়রার তীরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে বড় জাহাজ থেকে লাইটারে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা নিতে খরচ বেড়ে যাবে। আর খরচ বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বিদ্যুতের দামেও।