শ্রম আইন সংশোধনের প্রস্তাব

মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা চায় মজুরি বোর্ড

দেশের সংবিধিবদ্ধ মজুরি নির্ধারণকারী একমাত্র সরকারি সংস্থা নিম্নতম মজুরি বোর্ড। নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

দেশের সংবিধিবদ্ধ মজুরি নির্ধারণকারী একমাত্র সরকারি সংস্থা নিম্নতম মজুরি বোর্ড। নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিংবা কলকারখানায় সরজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের তদারকির কোনো সুযোগ নেই। তাই এ সুযোগের পাশাপাশি অনিয়ম হলে মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা চেয়েছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। শ্রম মন্ত্রণালয়ে গত বুধবার দেয়া এক চিঠিতে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ স্বাক্ষরিত ‘‌বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বিধিমালা সংশোধন বা সংযোজনসংক্রান্ত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের প্রস্তাব বা মতামত’ সংক্রান্ত চিঠিতে আরো বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ‌উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে শক্তিশালীকরণ ও শ্রমিকদের মজুরি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা সংশোধন বা সংযোজন করা প্রয়োজন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শ্রম আইন ২০০৬-এর ভিত্তিতে পাঁচ বছর অন্তর বিভিন্ন খাতের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করতে পারে সরকার। মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ৪৩টি শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি হার নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে গত এক দশকে ঘোষণা হয়েছে ২৯টি মজুরি কাঠামো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এসব মজুরি কাঠামো অনেকটাই সেকেলে। কেননা এ অর্থ দিয়ে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা যেমন কর্মজীবনে দুর্বিষহ সংগ্রাম করছেন, তেমনি পরিবার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন অনিশ্চয়তায়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইন সংশোধনের বিষয়টি কেবল শ্রম আইনের কয়েকটি ধারায় সংযোজন-বিয়োজন কিংবা নতুন নতুন ধারা সন্নিবেশের চক্রে পড়ে গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। এজন্য ঢেলে সাজাতে হবে সরকার, মালিক ও শ্রমিক—ত্রিপক্ষীয় সমন্বিত ব্যবস্থাকে। সেই সঙ্গে এ তিন পক্ষের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে হবে। শ্রমিকের নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সমাজ এখনো পিছিয়ে আছে এবং বৈষম্যহীন শ্রম পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরগুলো শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে। ফলে শ্রমিকরা ঝুঁকিতে রয়েছেন।’

পোশাক শ্রমিকদের প্রতিনিধি ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর ২০২৩ সালের নভেম্বরে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা দেয় সরকার। সর্বনিম্ন মজুরি রাখা হয় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এর আগে তা ৮ হাজার টাকা ছিল। সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি হলে মূল বেতন হবে ৬ হাজার ৭০০ টাকা। এর অর্ধেক বাড়ি ভাড়া। এছাড়া খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ ও যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রতি বছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়বে। ওই মজুরি কাঠামোয় সাতটির বদলে পাঁচটি গ্রেড থাকার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও অনেক দিন ধরে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন শ্রমিকরা।

সরকার নির্ধারণ করে দিলেও দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এ মজুরি কাঠামো মেনে চলে না বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। বিষয়টি স্বীকার করেছেন নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যে গেজেট করেছি এটার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কয়েকটি কারখানা বাস্তবায়ন করবে, অন্যরা করবে না সেটি হতে পারে না। অনেক শ্রমিক হয়তো জানেন না বিষয়টি। তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। মালিকদের সক্ষমতা থাকার পরও তারা স্যালারি দিচ্ছেন না। আমরা মালিকদের সঙ্গে কথা বলেই তো মজুরি নির্ধারণ করি। তার পরও কেন শ্রমিকদের ঠকাবেন তারা?’

এ কারণেই শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চিঠিতে বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনসংক্রান্ত বেশকিছু প্রস্তাব ও মতামত দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সংস্থাটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা পেতে শ্রম আইনে দুটি পৃথক উপধারার সমন্বয়ে ১৪৯(৪) ধারা সংযোজনের সুপারিশ করেছে। ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের ‘‌নতুন ধারা ১৪৯(৪) সংযোজন’ প্রস্তাবের ‘‌ক’ উপধারায় বলা হয়েছে, শ্রম আইন ধারা ২৮৯, ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬-এ বর্ণিত অপরাধের বিচারকল্পে কিংবা প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী মজুরি, সুবিধাদি কিংবা আনুতোষিক দেয়া হচ্ছে কিনা তা যাচাই ও নিশ্চিতকরণকল্পে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারবেন।

একই ধারার ‘‌খ’ উপধারায় বলা হয়েছে, নিম্নতম মজুরি বোর্ড প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের সামনে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত মজুরি, সুবিধাদি বা আনুতোষিকসংক্রান্ত অপরাধ তাৎক্ষণিক আমলে নেয়া যাবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এ আইনে নির্ধারিত দণ্ড দিতে পারবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়টি আইনে নেই। আমরা এটি নতুন করে চাচ্ছি। বোর্ড থেকে আমরা শুধু মজুরির সুপারিশটা মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। মজুরি ঘোষণা হওয়ার পর সেটির বাস্তবায়ন তদারক করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। তারা আসলে সম্পূর্ণভাবে বিষয়টি দেখে না। সে করণে আনরেস্টগুলো হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু মজুরি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই হচ্ছে। ১৪৮ ধারায় বলা আছে, মালিক মজুরি দিতে বাধ্য থাকবেন। এটা কম দিতে পারবেন না। তাই আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা চাচ্ছি, যেন কোনো অভিযোগ এলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে গিয়ে দেখতে পারি সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। আর না হলে বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেব। অর্থাৎ বিভিন্ন সংস্থায় যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা রয়েছে সেটি আমরা মজুরি বোর্ডেও চাচ্ছি।’

শ্রম আইনে নতুন ১৪৯(৩) ধারা সংযোজনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। ধারাটির কার্যক্রমের বিবরণে বলা হয়েছে, ‌মজুরি হার বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে নিম্নতম মজুরি বোর্ড সমগ্র দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কারখানা সরজমিন পরিদর্শনপূর্বক তদারকির মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করবে। আর ধারা ১৩৮ (৫)-এ নতুন শর্তাংশে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বা অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদায় আসীন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন।

নতুনভাবে সংযোজনের জন্য ধারা ১৩৮(৬)-এর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে বোর্ড সদস্য হিসেবে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট শিল্পের প্রকৃত মালিক ও শ্রমিককে প্রতিনিধিত্ব করেন মর্মে নিশ্চিতপূর্বক নিযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

নিজেদের জনবলের সংকট রয়েছে উল্লেখ করে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, ‘জনবল সংকট নিরসনের জন্য উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করছি। এভাবে একটি সংস্থা চলতে পারে না। জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাবও আমরা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। এখন ৪৬টি সেক্টর বোর্ডে চলছে। বোর্ডের কার্যক্রম আরো শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট করার জন্য আমাদের গবেষণার জন্য আরো জনবল প্রয়োজন।’

আরও