বড় আকারের খেলাপি ঋণের চাপে নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশের বেশি এরই মধ্যে খেলাপির খাতায় উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত পাল্টা শুল্কনীতি দেশের ব্যাংক খাতকে আরো কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৩০-৪০ শতাংশই বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট। এ খাতে কিছু ব্যাংকের বিনিয়োগ নিজেদের ঋণ পোর্টফোলিওর অর্ধেকেরও বেশি। ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য তথা ঋণপত্রের (এলসি) বড় অংশ বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতকে ঘিরে আবর্তিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি কমে গেলে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি এ খাতে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৪৪০ কোটি বা ৪৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭ শতাংশই রফতানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাতের হাত ধরে। পণ্যটি প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর আওতায় সক্রিয় রয়েছে ২ হাজার ১০৪টি কারখানা। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে দাবি করে সংস্থাটি।
তৈরি পোশাক পণ্যের কাঁচামাল সুতা ও কাপড় উৎপাদনকারী শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন বিটিএমএ। স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং কারখানা মিলিয়ে এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৮৫০। সংগঠনটির দাবি, বস্ত্র খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের বেসরকারি খাতে একক বিনিয়োগ হিসেবে সর্বোচ্চ।
বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতি ঘোষিত হয় ২ এপ্রিল। ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন শুল্কনীতি কার্যকর হয়েছে ৫ এপ্রিল থেকে। যদিও ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যাদেশ স্থগিত করেছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি চামড়াসহ অন্যান্য পণ্যের কার্যাদেশও স্থগিত হতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
ট্রাম্পের ঘোষণার পর বাংলাদেশের রফতানিকারকদের মতো ব্যাংকাররাও আতঙ্কিত বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের মোট রফতানির ৮৫ শতাংশের বেশি হলো তৈরি পোশাক। আর প্রতিটি ব্যাংক যে ঋণ দেয়, তার ৩০-৪০ শতাংশ হলো বস্ত্র ও তৈরি পোশাককেন্দ্রিক। ব্যাংকভেদে এ হার বেশিও আছে। ফান্ডেড এ ঋণের পাশাপাশি রয়েছে নন-ফান্ডেড ঋণও। ট্রাম্পের শুল্কনীতি ঘোষণার প্রভাবে ব্যাংকের আয় কমে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার আরো বাড়বে।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, ‘ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে ভোক্তারা তাদের চাহিদা কমাবে। ফলে দেশে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রভাব পড়বে ব্যাংকের ওপর। আশার কথা হলো সরকারের পক্ষ থেকে ত্বরিত কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।’
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতের ক্ষত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে দেশের ১৫টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন এসেছে। অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ওই ব্যাংকগুলোতে এখন দেশী-বিদেশী অডিট ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষা চলছে। এতে বের হয়ে আসছে হাজার হাজার কোটি টাকার বেনামি ঋণ। কিস্তি পরিশোধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে অনেক ঋণ খেলাপির খাতায় উঠতে শুরু করেছে। পর্ষদ পুনর্গঠিত হওয়া ব্যাংকগুলোর নতুন খেলাপি ছাড়াই গত ডিসেম্বরের শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। যদিও ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার দেখানো হয়েছিল মাত্র ৯ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণের স্থিতি দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের দাবি, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার আরো বাড়বে। এ হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি বছর ‘ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট’ নামে একটি প্রকাশনা বের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ২০২৩ সালের পর এখন পর্যন্ত প্রকাশনাটির নতুন কোনো সংখ্যা প্রকাশ হয়নি। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই সময় পর্যন্ত দেশের তৈরি পোশাক খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ ঋণ ছিল খেলাপি। তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও বস্ত্র খাতের বিভিন্ন কোম্পানিতে ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এ ঋণের ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ খেলাপির খাতায় উঠে গিয়েছিল। গত বছর তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ও খেলাপির হার আরো অনেক বেড়েছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার। তিনি বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতির প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নানাভাবে পড়বে। তবে কতটুকু পড়বে, সেটি বিচার-বিশ্লেষণ করার সুযোগ আছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এখন উৎপাদিত পণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত হলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটিই স্বাভাবিক। কোনো কোম্পানি প্রত্যাশিত মাত্রায় ব্যবসা করতে না পারলে তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। এর প্রভাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে। আর ব্যাংক খাত ক্ষতির মুখে পড়লে সামগ্রিক অর্থনীতিতে সেটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। আর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। ট্রাম্পের ঘোষিত নীতিতে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি হারে শুল্ক আরোপ হয়েছে চীন ও ভিয়েতনামের ওপর। পাল্টা শুল্ক হিসেবে বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ আরোপ করা হলেও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এ হার ৪৬ শতাংশ। তবে শুল্কের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের ওপর ২৭ ও পাকিস্তানের ওপর ৩০ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প সরকার।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিকও দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীদের কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ট্রাম্পের ঘোষণায় তৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রভাব পড়লেও সেটি খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। আপাতত কিছু পণ্যের অর্ডার স্থগিত হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
তিনি বলেন, ‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের সিদ্ধান্তের আওতায় আছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ। এক্ষেত্রে কারো কম, কারো বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ যেসব পণ্য রফতানি করে তার বেশির ভাগই কম মূল্যের। বাংলাদেশের রফতানীকৃত পোশাক ও পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নিত্য ব্যবহার করে। এ কারণে দামি পোশাক কম কিনলেও মার্কিনরা কম দামের বাংলাদেশী পণ্য বেশি কিনতে পারেন। ফলে দাম বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা আগের চেয়েও বেড়ে যেতে পারে।’
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের কোনো শঙ্কা নেই বলে মনে করেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। তার কথায়, ‘ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে আমি অন্তত কোনো শঙ্কা দেখি না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো চীন ও ভিয়েতনাম। এ দুটি দেশের ওপর বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হারে শুল্কারোপ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা এ দুটি দেশে যাবে না। ভারত ও পাকিস্তানও এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না। কারণ এ দেশ দুটির যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রফতানির সক্ষমতা নেই। এ সক্ষমতা রাতারাতি তৈরি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শ্রমিকদের মতো উৎপাদনক্ষমতা ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের নেই। এজন্য ঘুরেফিরে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রেতারা বাংলাদেশেই আসতে বাধ্য হবেন। আর প্রধান উপদেষ্টা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে যদি সাফল্য পাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশের সামনে রফতানি বৃদ্ধির অমিত সম্ভাবনাও রয়েছে।’