মানব পাচারের ঘটনায় মামলা

ছয় বছরে আসামি প্রায় ২০ হাজার, ১ শতাংশেরও কম সাজার হার

নারায়ণগঞ্জের সালমা খাতুন। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ইতালি যাওয়ার লক্ষ্য স্থির করেন। কম টাকায় স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ২০২১ সালে যাত্রা করেন এ নারী। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। সেখান থেকে বিমানে করে ইতালি পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবেশী দেশটিতে আটকে রেখে উল্টো নির্যাতন চালানো হয়।

অর্থ আদায় করা হয় পরিবারের কাছ থেকে। অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে একসময় ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হন সালমা। জেল খাটেন ছয় মাস। দেশে ফিরে সাতজনের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেন। তবে সব আসামিই খালাস পেয়ে যান।

মানব পাচারের ঘটনায় গত ছয় বছরে প্রায় ২০ হাজার জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে সাড়ে চার হাজারের মতো। এসব মামলায় সাজা হয়েছে ১ শতাংশেরও কম, অর্থাৎ দশমিক ৮১ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময় অবৈধ পথে বিদেশে যেতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭২ বাংলাদেশী।

আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশের দুর্বল তদন্তের কারণে এসব মামলায় সাজা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টদের দাবি, সাক্ষী না পাওয়া এবং দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীরা মামলা চালানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে মানসম্মত তদন্ত ও ভোগান্তিহীন বিচারিক প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

মানব পাচারের ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো মনিটরিং করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মানব পাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে মোট ৪ হাজার ৫৪৬টি। এতে আসামি করা হয়েছে ১৯ হাজার ২৮০ জনকে। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে সাজা হয়েছে কেবল ১৫৭ জনের। এর মধ্যে ২৪ জনের যাবজ্জীবন ও ১৩৩ জনকে দেয়া হয়েছে অন্যান্য মেয়াদে সাজা। এসব মামলায় গুরুতর অভিযোগ থাকলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই। এর বিপরীতে গত ছয় বছরে মানব পাচারের মামলায় খালাস পেয়েছে ৩ হাজার ১৪১ জন। সবচেয়ে বেশি আসামি খালাস পেয়েছে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে।

টিকটকের আড়ালে উঠতি বয়সী তরুণীদের ভারতে পাচার করে আসছিল একটি চক্র। পাচারের শিকার হওয়া এক তরুণী ২০২১ সালের ৭ মে পালিয়ে দেশে এসে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। হাতিরঝিল থানায় ওই বছরের ১ জুন দায়ের মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়। প্রায় চার বছরেও আলোচিত মামলাটির তদন্ত শেষ হয়নি। অথচ একই ঘটনায় ভারতে গ্রেফতার আসামিদের বিচার-পরবর্তী শাস্তিও হয়েছে।

হবিগঞ্জের সোহেল নামে এক টিকটকার তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ২০২২ সালে ভারতে যান। কথা ছিল তারা টিকটক ভিডিও বানাবেন। কিন্তু নারী পাচারকারী কয়েকজনের হাতে স্ত্রীকে তুলে দিয়ে কৌশলে সটকে পড়েন সোহেল। এ ঘটনায় তার শ্বশুর মামলা করলেও তদন্তই শেষ হয়নি আজ পর্যন্ত।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানবপাচারের মামলাগুলোর অন্যতম চ্যালেঞ্জ যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাদী-বিবাদী নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলেন। কোনো পক্ষ দেশের বাইরে থাকলেও বিচারের প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়। জিম্মি হওয়া ব্যক্তি যদি দেশের ভেতরে থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে দেশের বাইরে ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে।’

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, পাচারকারীরা একপ্রকার ধরেই নিয়েছে মানব পাচার মামলার বিচার হয় না। এজন্য তারা বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মানব পাচার মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছিল। আবার অনেক অভিযোগ মামলা পর্যন্ত গড়ায় না, আড়ালেই থেকে যায়। কখনো মামলা হলেও বিচার শেষ হতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। তখন অনেকেই সমঝোতায় চলে যান।

পুলিশের দুর্বল তদন্তের কারণে মানব পাচারের অধিকাংশ মামলাতেই আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মানব পাচারের মামলাগুলো যেন পুলিশের জন্য লাভজনক মামলায় পরিণত হয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা দুই পক্ষের থেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হন। তারা বিচারের সময় সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করেন না। আবার এসব মামলার তদন্তে আগে যেমন নজরদারির ব্যবস্থা ছিল, এখন সেটাও নেই। ফলে পুলিশ যেমন তেমন একটা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। আর তাদের এ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব হয় না বলেই আসামিরা খালাস পেয়ে যায়।’

অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘অপরাধীরা মানব পাচারের মতো অপরাধ করে একবার যখন পার পেয়ে যায়, পরে তারা সেটি বারবার করতে থাকে। এভাবেই দেশে একদিকে যেমন মানব পাচারের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনই অপরাধীদের সাজার হারও কমে আসছে।’

সাজার হার খুব সামান্য হলেও অবৈধ পথে বিদেশে যেতে গিয়ে প্রাণহানির সংখ্যা কম নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, বাংলাদেশীদের বিদেশে যাওয়ার চাহিদা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। এটিকে পুঁজি করে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী সংঘবদ্ধ চক্র নানা কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারিত করছে। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইতালি যাওয়ার পথে একটি ডিঙি নৌকা ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে ডুবে যায়। এতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে বাংলাদেশীই ছিলেন আটজন। এছাড়া ২০২০ সালে লিবিয়ার মিজদাহে পাচারকারীদের গুলিতে নিহত হন ২৬ বাংলাদেশী। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রাণ হারান ৩৯ বাংলাদেশী।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. ওমর ফারুক ফারুকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আসলে আমাদের এখানে মানবপাচারের মামলাগুলোর বেশির ভাগই প্রতারণাসংক্রান্ত। যেমন ধরেন, কেউ ভিসা নিয়ে বিদেশে গেছেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাননি। তখন দেশে তার আত্মীয়-স্বজন মানব পাচারের মামলা করে দেন। পরে দেখা যায়, বিচার চলা অবস্থায়ই বাদী ও বিবাদী পক্ষ আপস করে নিয়েছেন। একটা পর্যায়ে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এর বাইরে প্রকৃত মানব পাচারের যে মামলাগুলো আসে, যেমন ধরেন খারাপ কাজের জন্য ভারতে কিংবা লিবিয়া ও লেবাননে নারী পাচার হয়ে থাকে। এসব ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক বিচার নিশ্চিত করা যায়।’

আরও