ভ্যাটজাল নয়, ভ্যাটহার বাড়ানোর আগ্রহ বেশি এনবিআরের

শপিংমলের খুচরা ব্যবসায়ীদের প্রায় ৭৮ শতাংশ ভ্যাট নিবন্ধন নেননি। নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট গোয়েন্দা) ২০২২ সালের জরিপের তথ্য এটি।

শপিংমলের খুচরা ব্যবসায়ীদের প্রায় ৭৮ শতাংশ ভ্যাট নিবন্ধন নেননি। নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট গোয়েন্দা) ২০২২ সালের জরিপের তথ্য এটি। আর বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির দাবি, দেশে ৪ লাখ ৮২ হাজার রেস্তোরাঁ থাকলেও ৭০ শতাংশ ভ্যাট দেয় না। এ দুই তথ্যেই বোঝা যায় খাতভিত্তিক ভ্যাটের আওতার বাইরে রয়ে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এগুলোকে ভ্যাটের আওতায় না এনে গত বৃহস্পতিবার নতুন করে ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে শতাধিক পণ্য ও সেবার।

উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক অর্থনীতি যখন সংকটে, তখন বর্ধিত এ ভ্যাট মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াবে। চাপে পড়বেন ব্যবসায়ীরাও। এ নিয়ে সারা দেশে চলছে সমালোচনা।

এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ৪৪ হাজার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩ লাখ ৭১ হাজার। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার। এনবিআরেরই করা পরিসংখ্যান দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ভ্যাটদাতা না বাড়িয়ে ভ্যাটের হার বৃদ্ধিতে বেশি মনোযোগ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)।

এনবিআর সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি) ড. মো. আব্দুর রউফ জানান, ‘ভ্যাট নিবন্ধনের সংখ্যা এখন ৫ লাখ ৪৪ হাজার। অনলাইন ও হার্ড কপি মিলে এখন মাসে প্রায় চার লাখের কাছাকাছি রিটার্ন দাখিল হয়।’

এনবিআরের ভ্যাট বিভাগসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে বাংলাদেশের ভ্যাট ব্যবস্থাপনার একটি বড় ত্রুটি হলো তথাকথিত ফিক্সড ভ্যাটের প্রচলন। এতে ভ্যাট ব্যবস্থা যেমন অকার্যকর হয়, তেমনি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ফাঁকিও আকাশচুম্বী!

মিষ্টির দোকানে এতদিন সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিত ভোক্তারা। এখন থেকে দিতে হবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু ভোক্তারা এ ভ্যাট দিলেও দোকানদারদের বিরুদ্ধে ভ্যাট চালান না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভোক্তারা ভ্যাট দিতে চায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরেরই আয়কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাসায় যাব। সেখানকার একটি দোকান থেকে মিষ্টি কিনলাম। দাম পরিশোধের সময় ভ্যাট চালানের কথা জিজ্ঞাসা করলে বিক্রেতা জানালেন যে ভ্যাট চালান দেয়া হয় না। আরেক দিন কাজীপাড়ায় অবস্থিত একই ব্র্যান্ডের দোকানে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়।’

কোনো প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক ব্যবসায় শনাক্তকরণ নম্বর (ইবিআইএন) না নিলে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে ভ্যাট আইনে। এছাড়া নিবন্ধন সনদ যথাযথভাবে প্রদর্শন না করলেও ১০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইনের এ বিধান বাস্তবায়নে অনীহা রয়েছে এনবিআরের। এ বিধান বাস্তবায়ন করা গেলে ভ্যাটদাতা বাড়ত বলে মনে করেন এনবিআরের ভ্যাট বিভাগসংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে এনবিআর সদস্য ড. মো. আব্দুর রউফ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইনের প্রয়োগ হয়। হয়তো ব্যাপকভাবে হয় না। তবে প্রয়োগ হয়।’

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য (ভ্যাট ও কাস্টমস) ফরিদ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনফোর্সমেন্ট তো করা হয় না। কেতাবে আছে বাস্তবায়নে নেই। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনামের তুলনায় গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ১৫ শতাংশ অযৌক্তিক। ১৫ শতাংশ কি আদায় হয়, নাকি যোগসাজশে ৫ শতাংশ আদায় করে ১০ শতাংশ খেয়ে ফেলে! দোকানে দোকানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর জন্য ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। উল্টাপাল্টা খরচ করে ৪০০ কোটি খেয়ে ফেলেছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক মান দাবি করে প্রণয়ন করা আইন একই সরকার ও সংসদ ২০১৯ সালে বাতিল করে দিয়ে পুরনো ১৯৯১ সালের আইনে ফিরে গেছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের সাবেক এক সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে বাংলাদেশের ভ্যাট ব্যবস্থাপনার আরো একটি বড় ত্রুটি হলো তথাকথিত ফিক্সড ভ্যাটের প্রচলন। এতে ভ্যাট ব্যবস্থা যেমন অকার্যকর হয়, তেমনি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ফাঁকিও আকাশচুম্বী! এমনও দেখা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের মাসিক প্রদর্শিত নিট প্রদেয় ভ্যাটের চেয়ে ট্রেজারি স্থিতি ১০-২০ গুণ। এখানে প্রশ্ন হলো, এমন বিশাল পরিমাণ ট্রেজারি জমা কেন এ প্রতিষ্ঠানগুলো দেয়? উত্তর হলো তারা তাদের ব্যবসার একটি নগণ্য পরিমাণ ভ্যাট দিয়ে বিশাল পরিমাণ ফাঁকি দেয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অডিট করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।’

গত ৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘১৯৯১ সালে প্রথম ভ্যাট আইন করার পর ২০১২ সালে আবার নতুন করে আইন করা হয়। তবে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে আইন করায় তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে দেশে আয়করদাতা কোটি ছাড়ালেও ভ্যাটদাতা মাত্র পাঁচ লাখ।’

৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেশে ৪ লাখ ৮২ হাজার রেস্তোরাঁ থাকলেও ৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ ভ্যাট দেয় না। তারা ভ্যাটের নিবন্ধনও নেয়নি। অথচ সরকার তাদের ভ্যাটের আওতায় না এনে ভ্যাটের হার বাড়াচ্ছে।’

এনবিআর সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি) ড. মো. আবদুর রউফ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোক্তা ভ্যাট দিতে চায় না এ কথা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। জনগণ সাধারণত ভ্যাট দিতে চায়। জনগণের একটা ছোট অংশ ভ্যাট দিতে চায় না এ কথা সঠিক। রেস্তোরাঁ যদি ভ্যাট চালান ইস্যু করে তাহলে ক্রেতার ভ্যাট না দিয়ে বিকল্প নেই। তাই এ ধরনের কথা শুধু যুক্তিতর্কের জন্য বলা যায়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভ্যাট ব্যবস্থার মূল সমস্যা হলো আইন বা নীতির পরিপালন। এক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে। মূলত বর্তমান ডিজিটাল সিস্টেমের যথাযথ ব্যবহার করেও পরিপালন ঘাটতি বের করা সম্ভব। কোনো কোনো খাতে মূল্য সংযোজনের হার অনেক কম, এমনকি নেতিবাচক! সেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবচেয়ে কম মূল্য সংযোজনের কিছু সেক্টর যেমন সিমেন্ট, সিরামিক, রড ইত্যাদি খাতভিত্তিক কাজ শুরু করা যেতে পারে। বিশেষত, রডের ক্ষেত্রে নামমাত্র নির্ধারিত করহারের ভ্যাট হাস্যকর! এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট পলিসি প্রয়োগ করা যেতে পারে।’

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৭১ হাজার, আগের অর্থবছরে যা ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার। এক বছরে প্রায় ৮০ হাজার প্রতিষ্ঠান মূল্য সংযোজন করের (মূসক বা ভ্যাট) আওতায় এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্যাট গোয়েন্দা ক্লাবের প্রকাশনা ‘বিজয় শপথ’-এ উল্লেখ করা হয়, দেশে মোট প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এখনো একটি বড় অংশ নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। এতে সার্বিকভাবে ভ্যাটের ‘চেইন ইফেক্ট’ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর ২০২১ সালের মে মাসে এমন জরিপের আয়োজন করে। রাজধানী ও ঢাকার বাইরে এমন প্রতিষ্ঠান জরিপ করে দেখতে পায়, জরিপসংশ্লিষ্ট শপিংমলের খুচরা ব্যবসায়ীদের প্রায় ৭৮ শতাংশ ভ্যাট নিবন্ধন নেননি।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে নতুন করে দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেয়া কোনোভাবেই সমর্থন করে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। ভ্যাটহার বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে এবং করজাল সম্প্রসারণ করতে হবে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষতি করবে না।’

এনবিআর বলছে, আইন অনুসারে ব্যবসায়ী নিজেই একজন স্বীকৃত ভ্যাট সংগ্রাহক। তিনি এনবিআরের পক্ষে এ দায়িত্বটা পালন করেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ওই ব্যবসায়ী এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না বা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা করেন না। ক্রেতা দিলেও তা সরকার পাচ্ছে না। এটি তখন জনগণের টাকা ‘আত্মসাতের’ পর্যায়ে পড়ে। এ ধরনের কোনো অভিযোগ এলে তখন ভ্যাট কর্তৃপক্ষের জন্য তা আইন অনুসারে অনুসন্ধান বা তদন্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

আরও