স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এজন্য দফায় দফায় নেয়া হয়েছে প্রকল্পের পর প্রকল্প। জনগণের করের অর্থ থেকে জোগান দেয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার মূলধন। যদিও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রকল্প সরকারের মালিকানাধীন এ ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি থামাতে পারেনি। ঋণের নামে ক্ষমতাসীনদের অর্থ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াও বন্ধ করা যায়নি।
সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী—এ চারটি ব্যাংককে দেখা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে। ব্যাংকগুলোর মালিকানার ধরন ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। ওই বছর রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংককে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। তালিকাভুক্ত করা হয় দেশের পুঁজিবাজারে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকটির মালিকানায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। যদিও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ৩৮ বছর পার হলেও ব্যাংকটির পরিচালনার ধরনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং এখনো অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের ধরনেই পরিচালিত হচ্ছে ব্যাংকটি। সোনালী বা অগ্রণী ব্যাংকের মতো রূপালী ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগ দিচ্ছে সরকার।
১৯৯২ সালেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ওই সময় মূলধন পুনর্গঠন ও আর্থিক ভিত সুদৃঢ় করার কথা বলে ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বন্ডের মাধ্যমে ও নগদে বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দেয় সরকার। যদিও সংস্কার উদ্যোগের লক্ষ্য পরে বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। এরপর ২০০৪ সালে এসে আবারো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এন্টারপ্রাইজ গ্রোথ অ্যান্ড ব্যাংক মডার্নাইজেশন প্রজেক্ট (ইজিবিএমপি) নামে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা। সে সময় সবগুলো ব্যাংকে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিটও করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়। কিন্তু এসব সংস্কারও ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদের পাশাপাশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ক্ষমতা পেয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা আরো বেশি অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ লোপাটে প্রভাবশালীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এসে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৮ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। তবে সেপ্টেম্বরের পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। নভেম্বর শেষে এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার হবে অন্তত ৫০ শতাংশ। খেলাপি ঋণের উচ্চ এ হারের প্রভাবে চার ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতি তীব্র হয়ে উঠেছে। যথাযথ সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখা হলে বছর শেষে সবক’টি ব্যাংকই বড় লোকসানে পড়বে।
২০০৪ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ পান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। এর আগে তিনি সাউথইস্ট ও প্রাইম ব্যাংকের এমডি ছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকে কাজ না করা সত্ত্বেও কেবল যোগ্যতার বিচারে তাকে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। আর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়।
ওই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ এ ব্যাংকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে আমি কোনো আবেদনও করিনি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নিজে থেকে আমাকে নিয়োগ দিয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সে সময় আন্তর্জাতিক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান কেপিএমজিকে দিয়ে নিরীক্ষা করা হয়। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার উপদেষ্টা টিমে পিডব্লিউসির দুজন প্রতিনিধি ছিলেন। তিন বছরের মধ্যেই আমরা অগ্রণী ব্যাংকের সবক’টি সূচকে উন্নতি করেছিলাম। এ সাফল্য থেকেই ২০০৭ সালে অগ্রণী ব্যাংকের পাশাপাশি সোনালী ও জনতা ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছিল। এমডি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি ক্ষমতা বাড়িয়ে সিইওর দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল।’
ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে লাভ হয়েছে জানতে চাইলে জবাবে আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সংস্কার করতে হয়। কিন্তু সংস্কারের পর যদি সেটির ধারাবাহিকতা না থাকে, তাহলে কোনো উপকার হয় না। ২০১০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমি অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ছিলাম। ওই সময় ব্যাংকটির সবক’টি আর্থিক সূচক সুদৃঢ় ছিল। কিন্তু তারপর সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। এ কারণে অগ্রণী ব্যাংক এখন এতটা বিপদে পড়েছে। এখানে ব্যাংকের সুশাসনের রীতিনীতির প্রয়োগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তির সদিচ্ছা না থাকলে কোনোদিনই প্রতিষ্ঠান ভালো থাকতে পারে না। আর আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে, তাহলে সে ব্যাংক অবশ্যই বিপদে পড়বে।’
চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ২৬ হাজার ৮৯১ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি ৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপনও করেছে। ওই সময় পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ছিল ৪ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার বেশি। আর নভেম্বরে এসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই এখন খেলাপি। আর সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও মূলধন ঘাটতির পরিমাণ আরো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। বর্তমানে দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর জন্য বাজার থেকে অর্থ ধার করছে অগ্রণী ব্যাংক। যদিও আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে অন্য ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিত।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের বেশি শাসনকালে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। শেখ হাসিনা সরকারের চালু করা এ বিভাগটি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের এমডি নিয়োগের চূড়ান্ত ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা সীমিত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এমডি নিয়োগ চূড়ান্ত করে দেয়ার পরই সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদে অনুমোদনের পর চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনায় দ্বৈত এ শাসনের কারণে অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্র বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের এমডিকে একযোগে অপসারণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরপর পাঁচটি ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ চূড়ান্ত করা সম্ভব হলেও রূপালী ব্যাংক এখনো এমডিশূন্য। প্রায় তিন মাস এমডি না থাকায় ব্যাংকটিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েও রূপালী ব্যাংকে এমডি নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পরিচালনায় সরকারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতিও বেশ খারাপ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত রূপালী ব্যাংক ২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতেও ছিল। সেপ্টেম্বরের পর ব্যাংকটির পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের প্রায় ৩০ শতাংশ ঋণই খেলাপির খাতায় চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের পর রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদাকে নিয়োগ দেয়া হয়। ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়ার আগের তিন মাস রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ফাঁকা ছিল। এরপর প্রায় তিন মাস ধরে এমডি পদ ফাঁকা। এভাবে তো একটি ব্যাংক চলতে পারে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, তিন মাসের বেশি কোনো ব্যাংকের এমডি পদ ফাঁকা থাকার সুযোগ নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের এমডি নিয়োগ দেয়া আইনবিরুদ্ধও। এ ক্ষমতা কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের।’
নজরুল হুদা বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনে অনেক কঠোর বিধিবিধান আছে। সেসব মেনে চললে দেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। আইনে থাকলেই হবে না, আইন মেনে চলার মানসিকতাও লাগবে।’
এক সময় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি ছিল জনতার। কিন্তু গত দেড় দশকে সীমাহীন লুণ্ঠনে এ ব্যাংকটিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের ভাষ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ তথ্যের চেয়েও জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি আরো খারাপ। ব্যাংকটির পর্ষদে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৭৫ শতাংশেরও বেশি এখন খেলাপি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে যেকোনো সময় সিআরআর-এসএলআর ঘাটতিতে পড়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে ব্যাংকটি।
জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটি ৯৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। বিতরণকৃত এ ঋণের অর্ধেকের বেশি তথা ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা নিয়েছে মাত্র পাঁচটি গ্রুপ বা পরিবার। এর মধ্যে এককভাবে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপই নিয়েছে ২৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া এস আলম গ্রুপ ১০ হাজার ১৭১ কোটি, এননটেক্স গ্রুপ ৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৩ হাজার ৮০৭ কোটি ও ওরিয়ন গ্রুপ ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা নিয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই জনতা ব্যাংক পর্ষদে রাজনৈতিক নেতা, দলীয় আদর্শের শিক্ষক, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল বারকাত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দিন পর্যন্ত ব্যাংকটির অর্থ লুণ্ঠন অব্যাহত ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই ব্যাংকটি লুণ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবই সবচেয়ে বেশি ছিল বলে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
২০১২ সাল পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি ছিল ‘হলমার্ক’। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছিল গ্রুপটি। হলমার্ক ছাড়াও ব্যাংকটিতে আরো ছোট-বড় অনেক ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে। তবে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ মুহূর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য তিন ব্যাংকের তুলনায় সোনালীর আর্থিক সূচকগুলো কিছুটা ভালো। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকায়, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ।
সংস্কারের পরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এতটা নাজুক পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কিছু সংস্কার হলেও এখনো কাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি ব্যক্তির নৈতিকতার ঘাটতি রয়ে গেছে। ২০০৭ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত যে সংস্কার হয়েছিল, সেটি পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। পরবর্তী সময়ে সংস্কারের ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা হয়নি। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বাজার থেকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এমডি নিয়োগের সুযোগ ছিল। কিন্তু এখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়।’
মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর উন্নতি করতে হলে শক্তিশালী ও সৎ পর্ষদ নিযুক্ত করতে হবে। আর পর্ষদের হাতে এমডি নিয়োগ থেকে শুরু করে সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। পর্ষদের দায়িত্ব হবে কেবল নীতি প্রণয়ন। পর্ষদ কোনো অনিয়মে জড়ালে সরকারকে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে পুরো ব্যাংক খাতই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
প্রধান চার ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত আরো দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এগুলো হলো বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। লুণ্ঠনের শিকার হওয়া এ দুটি ব্যাংকের অবস্থাও নাজুক। দুটি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের বেশি। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকও রয়েছে তিনটি। সেগুলো হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় সরকারি খাতের এত ব্যাংকের কোনো দরকার নেই। সরকারের ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার জন্য কেবল একটি ব্যাংকই রাখা যায়। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া বা একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।’