খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। ওই অভ্যুত্থানের পর কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ৬ নভেম্বর পদত্যাগ করে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে আসেন তিনি। ৭ নভেম্বরের এক পাল্টা অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয় খালেদ মোশাররফের। সেদিন খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। যদিও দেশে একজন অরাজনৈতিক ও অবিতর্কিত রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন উল্লেখ করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে যান আগের দিন শপথ নেয়া বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও (সিএমএলএ) করা হয় তাকে। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (ডিসিএমএলএ) ও রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ডিসিএমএলএ এবং রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয় তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তাওয়াব ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএইচ খানকেও।
অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ওই সময়টায় বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ডেভিড ইউজিন বোস্টার। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ১০ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন মার্কিন এ রাষ্ট্রদূত। প্রতিবেদনটি এখন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস অব দ্য হিস্টোরিয়ানের নথিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বোস্টার লিখেছেন, নিম্নপদস্থ সৈনিকদের বিদ্রোহ সফল হওয়ার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তারা সেনা নেতৃত্বের কাছে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করে। তাণ্ডবকারী সৈনিকদের ভয়ে বিপুলসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যান এবং বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীদের হত্যার ঘটনা ঘটে। মোশাররফের ক্ষমতাচ্যুতের পর জেনারেল জিয়া, মোশতাক এবং অন্য সহযোগীদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন সরকার গঠন হয়। বৈঠকে খন্দকার মোশতাককে আবারো রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে খন্দকার মোশতাক বলেন, বিস্ফোরণোন্মুখ এমন পরিস্থিতিতে দেশের এমন একজন প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন; যিনি একই সঙ্গে অরাজনৈতিক ও অবিতর্কিত। এরই ধারাবাহিকতায় বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখার পাশাপাশি সিএমএলএর দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এর আগ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান স্বল্প সময়ের জন্য সিএমএলএর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দেশে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার তাগিদে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তে সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে এবং রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকেও সমর্থন জানানো হয়।
অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানময় এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেনাবাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তাদের অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়। আর খন্দকার মোশতাক নিজে আরেক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হন ৩ নভেম্বর ভোরে। প্রথম প্রহরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাশাপাশি রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার অনুগতরা। শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি মোশতাক সরকারের অনুগত ট্যাংক ক্রুদের মনোবল নষ্ট করতে রাজধানীর আকাশে ওড়ানো হয় মিগ যুদ্ধবিমান ও সশস্ত্র হেলিকপ্টার।
বোস্টার লিখেছেন, খালেদ মোশাররফ ওইদিন চারটি দাবি খন্দকার মোশতাকের কাছে তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম দাবি ছিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করা। বাকি দাবিগুলো হলো অভ্যুত্থানকারী মেজরদের সেনাবাহিনীর নিয়ম ও শৃঙ্খলার অধীনে ফিরিয়ে আনতে হবে, সরকারের প্রতি আনুগত ট্যাংক বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হবে এবং মোশতাক নিজে ক্ষমতায় থাকবেন।
শক্তির পাল্লায় পিছিয়ে পড়া খন্দকার মোশতাক রক্তপাত ও ভারতীয় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র তৈরির আশঙ্কা থেকে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আপসে আসেন। তবে এ আপসে যাওয়ার আগে কুমিল্লা সেনানিবাসে সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। সে সময় তাকে জানানো হয়, কুমিল্লা সেনানিবাসের কমান্ডার শুধু সেনাপ্রধান বা সিজিএসের আদেশে কাজ করবেন। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আপসে যেতে বাধ্য হন মোশতাক। তবে এর সুবাদে তাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা মেজররা নিরাপদে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পান। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর রাতে ঢাকা কারাগারে হত্যা করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামারুজ্জামানকে।
এ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বোস্টারের ভাষ্য হলো ‘এ কথা বিশ্বাস করার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে যে শুরুতে মোশতাকের মৃত্যু হলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এতে মোশতাকের সম্পৃক্ততা নিয়ে রহস্য দানা বাঁধে হত্যাকারী মেজরদের ঢাকা ত্যাগের পর। একটি সূত্রের ভাষ্যমতে, সোমবার মধ্যরাতে মেজরদের বহনকারী উড়োজাহাজ ঢাকা ত্যাগের আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে খালেদ মোশাররফের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এ হত্যার একটি উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো ভারতপন্থী সরকারের সম্ভাব্য নেতৃত্বকে অপসারণ করা।’
এদিকে মেজরদের দেশত্যাগের ঘটনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। পাশাপাশি পরের দুইদিন অর্থাৎ মঙ্গল ও বুধবার খন্দকার মোশতাক এবং মোশাররফের মধ্যে আলোচনা চলমান ছিল। বুধবার গভীর রাতে চিফ অব আর্মি স্টাফ বা সেনাপ্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয় খালেদ মোশাররফকে। আর বৃহস্পতিবার সকালে পদত্যাগ করেন মোশতাক। প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয় প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে। সেদিনই রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে সংসদ ভেঙে দেন। মন্ত্রিসভা সাবেক সরকারের নেতাদের হত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছে বলে সে সময় প্রচার করা হয়।
সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে তার সহকর্মী অনেক অফিসার ভালোভাবে নেননি বলে উল্লেখ করেছেন বোস্টার। তাদের কাছে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। সে সময় খালেদ মোশাররফকে দেখা হচ্ছিল ভারতীয় নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে। এ ধারণাকে প্রকট করে জেল হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় মঙ্গল ও বুধবারের দুটি মিছিলের ঘটনা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার প্রথম প্রহরেই বিদ্রোহ করে বসে সেনাবাহিনীর নিম্নপদস্থ সৈনিকরা। উৎখাত হন খালেদ মোশাররফ ও তার অনুগতরা। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন খালেদ মোশাররফ। সারা রাত ও সারা দিন ধরে ঢাকায় গোলাগুলি চলে। একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় প্রায় ৩০ জনের মৃত্যু হয়। অন্যান্য প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ সংখ্যা শতাধিক।