সাত জেলায় ২৮৫ সংরক্ষণ ঘরে ১০ হাজার টন পেঁয়াজ মজুদ

দেশের সাত জেলায় ২৮৫ মডেল সংরক্ষণ ঘরে এ মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও স্থানীয় পেঁয়াজচাষীদের দেয়া তথ্যমতে, এ মজুদের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। বিশেষজ্ঞরা জানান, এ পেঁয়াজ বাজারে এলে পণ্যটির বর্তমান উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।

দেশের সাত জেলায় ২৮৫ মডেল সংরক্ষণ ঘরে এ মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও স্থানীয় পেঁয়াজচাষীদের দেয়া তথ্যমতে, এ মজুদের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। বিশেষজ্ঞরা জানান, এ পেঁয়াজ বাজারে এলে পণ্যটির বর্তমান উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।

পেঁয়াজ মজুদ থাকা জেলাগুলো হলো দক্ষিণ-পশ্চিমের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং উত্তরের রাজশাহী ও পাবনা। জেলাগুলোয় ২৮৫টি ঘরের প্রতিটিতে ২৫০-৩০০ মণ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণক্ষমতা রয়েছে।

বিভিন্ন জেলার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এ জেলাগুলো প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন করে। এর পরিমাণ দেশের মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় অর্ধেক। হিসাবমতে, চলতি মৌসুমে এ জেলাগুলোয় প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩৫-৩৬ লাখ টন। এ মৌসুমে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ টন।

জেলাগুলোর মধ্যে ৪৪ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে পাবনা। এ জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফরিদপুর। এ জেলায় চাষ হয়েছে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে।

সরকারের ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, এসব পেঁয়াজের বড় একটি অংশ উৎপাদন মৌসুমে সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না। ভরা মৌসুমে সর্বত্র কমবেশি পেঁয়াজ সহজলভ্য হওয়ায় দাম কম থাকে। দাম কম থাকার কারণে প্রথমে বেকায়দায় পড়েন কৃষক। মৌসুমের উৎপাদন খরচ মেটাতে তারা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। পেঁয়াজের বড় একটি অংশ তখন চলে যায় দালাল ও মজুদদারদের হাতে। বছরের বিভিন্ন সময়ে এ মজুদদাররা পেঁয়াজের বাজার দখল করে রেখে মুনাফা করেন।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরের উল্লিখিত জেলাগুলোর প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত কৃষকদের মডেল সংরক্ষণ ঘর নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে। উদ্ভাবন করা হয় পেঁয়াজ সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘর। এ ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ছয়টি বায়ু নিষ্কাশন পাখা সংযুক্ত থাকে। মূলত ভেন্টিলেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণে সংরক্ষিত পেঁয়াজ-রসুন পচে না। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ঘরে হাইগ্রোমিটার রয়েছে। প্রতিটি ঘরের আয়তন প্রায় ৩৭৫ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে ২৫০-৩০০ মণ (১০-১২ টন) পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। তিনটি স্তরের এ সংরক্ষণ ঘরের স্থায়িত্ব কমপক্ষে ১৫-২০ বছর। এসব ঘরে পাঁচ-সাত মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। প্রতি পাঁচজন কৃষক একটি করে ঘর ব্যবহার করতে পারেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন ও বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে এসব ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মোট বাজেট ২৫ কোটি টাকা। এ অর্থে সাত জেলার ১২টি উপজেলায় ৩০০টি ঘর নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়। এরই মধ্যে ২৮৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এ সংরক্ষণ ঘর উদ্বোধন করা হয়।

বিভিন্ন জেলা থেকে তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, এসব মডেল ঘরে কৃষক নির্দেশিত ৩০০ মণের জায়গায় দুই-তিন গুণেরও বেশি পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছেন। কোথাও কোথাও অনেক কৃষক নিজেরা মডেল অনুসরণ করে ঘর তৈরি করে সেখানে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন।

রাজবাড়ী জেলায় এ বছর ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। সেখান থেকে অন্তত চার লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। জেলার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বালিয়াকান্দিতে ৩০টি ও কালুখালী উপজেলায় ২০টি ‘মডেল’ ঘর তৈরি করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ফরিদপুরের সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায় ৬৫টি মডেল ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এ জেলা পেঁয়াজ উৎপাদনের দিক দিয়ে দেশে দ্বিতীয় অবস্থানে। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ওই দুই উপজেলায়।

ফরিদপুর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩৬ টন।

কর্মকর্তাদের মতে, ভরা মৌসুম, তার পরও বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের বিক্রির পর এসব সংরক্ষণ মডেল ঘরে এখনো পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। এসব পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করা উচিত। বর্তমান বর্ধিত দাম থেকে মজুদদাররা লাভবান হচ্ছেন। এখন বিক্রি করা হলে কৃষকদের প্রায় তিন গুণ লাভ থাকবে।

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রাজবাড়ী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা মো. রাজীব খান বলেন, ‘এসব মডেল ঘরে প্রকৃত চাষীরাই পেঁয়াজ রাখছেন। কোনো কৃষকের ২০০ মণ, কারো ৫০০, কারো ৫০ মণও রয়েছে। তারা বেশি লাভের আশায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন।’

ঊর্ধ্বতনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি জানান, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনো দ্রব্য মজুদ করা যাবে। দেশে এ মুহূর্তে পেঁয়াজের বাজারদর যে রকম, তাতে কৃষকদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত ওপর মহল থেকে নিতে হবে।

গতকাল কুষ্টিয়ার খুচরা বাজারগুলোয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০৫ টাকা কেজিদরে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সুজাত আলী জানান, দেশে পেঁয়াজের দাম কখনই ১০০ টাকা কেজি হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি এটাকে সর্বনাশা মুনাফা হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে সর্বোচ্চ খরচ ২৫ টাকা ৫০ পয়সা। যদি দাম কখনো কোনোভাবে দ্বিগুণ হয়, তার পরও ৬০ টাকার বেশি করার সুযোগ নেই। এ দাম থেকেও কৃষক দ্বিগুণ লাভ তুলে আনতে পারেন।’ তিনি দেশজুড়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে একযোগে সমন্বয় করার ওপর জোর দেন। এতে পেঁয়াজের দাম সঠিক পর্যায়ে ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

সরকারের মডেল ঘরে পেঁয়াজ রাখা মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান পল্টু জানান, এ বছর তিনি এক একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে উন্নত জাতের রানী-১ পেঁয়াজের চাষ করেন। প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পেরেছেন। ২০ মণ পেঁয়াজ বিক্রি করে বাকিটা মডেল ঘরে রেখেছেন। এপ্রিল থেকে শুরু করে তিনি সেপ্টেম্বরের দিকে পেঁয়াজ বিক্রি করে ওই অর্থ দিয়ে অন্য ফসল উৎপাদনের খরচ মেটাবেন। এখন বিক্রি করে ফেললে তার হাতের অর্থ খরচ হয়ে যাবে। তিনি বিপাকে পড়বেন।

সরকারের উচ্চ মহল থেকে পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত আশা করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এহতেশাম রেজা। তিনি জানান, জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষিত পেঁয়াজ বিক্রি করে ফেলতে বলাটা যথেষ্ট সহজ নয়।

আরও