আলুবীজের তীব্র সংকট বেশি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষককে

দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টনের মতো। সেখানে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে আলু উৎপাদন হয়েছে ৩০

দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টনের মতো। সেখানে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে আলু উৎপাদন হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন বেশি। অথচ এবারের মৌসুমে ফসলটি চাষ করতে গিয়ে বীজ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষক। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে মণপ্রতি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। মূলত কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আলুবীজের বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে বলে অভিযোগ।

রংপুর জেলায় দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়। সে জেলায় আলুবীজের তীব্র সংকট। চাহিদার তুলনায় এর সরবরাহ কম, এমনকি সরকারি বরাদ্দও অপ্রতুল। ফলে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ দামে বীজ সংগ্রহ করতে হচ্ছে কৃষককে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি বছর আলুর উৎপাদন মৌসুমে কৃষক প্রতি কেজিতে ১০-২০ টাকা লাভ করেছেন। আর যারাই আলু মজুদ করেছেন তারাও প্রতি কেজিতে প্রায় ২০ টাকা লাভ করেছেন। তাই এবার আগামী বছরের জন্য ব্যাপক হারে আলু চাষ করা হচ্ছে, সে অনুযায়ী জমির পরিমাণও বেড়ে গেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী আলুর বীজ নেই। তাই সংকট তৈরি হয়েছে। দামও সেই হারে বেড়েছে।’

বিএডিসির তথ্য অনুযায়ী, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলায় আলু চাষের জমি বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ২০২ হেক্টর। উল্টো ছয় বছরে বীজের সরকারি বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৪২৮ দশমিক ৭৫৯ টন। চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় আলুবীজের সম্ভাব্য চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার টন। সেখানে সরকারি বরাদ্দ মাত্র ২ হাজার ৭৯৭ দশমিক ৩২ টন রেখেছে বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। কৃষক বলছেন, সরকারিভাবে বরাদ্দ কম থাকায় ইচ্ছামতো আলুবীজের দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহীপুরের আলুচাষী হোসাইনুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বছর চার বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছি। প্রতি বিঘায় বীজ লেগেছে দুই-আড়াই মণ। গত বছর যে বীজ ৫০-৬০ টাকা কেজি কিনেছি সেটি এবার ১০০-১১০ টাকায় কিনতে বাধ্য হয়েছি। তবে আমার নিজস্ব কিছু বীজ থাকায় খরচের হাত থেকে অনেকটা বেঁচে গেছি।’

বিএডিসির আলুবীজ বেশ মানসম্পন্ন। তাই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজের চেয়ে এর চাহিদাও বেশি। সরকারি সংস্থাটি বেশ কয়েকটি আলুর জাত বিতরণ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিএডিসি আলু-১ (সানসাইন), বিএডিসি আলু-৩ (সান্তানা), বারি আলু-১৩ (গ্র্যানুলা), বারি আলু-২৯ (কারেজ), বারি আলু-৮৫ (৭ ফোর ৭), বারি আলু-২৫ (এস্টারিক্স), বারি আলু-৯০ (অ্যালুইটি), বিএডিসি আলু-২ (প্রাডা), বিএডিসি আলু-৮ (ল্যাবেলা), বিয়ান্না ও কিং রাসেট। ২০-৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আলুবীজ বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএডিসির রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. মাসুদ সুলতান।

সরকারি বীজ বিতরণ শুরু হলে বাজারে অনেকটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে—এমন আশা ব্যক্ত করে মো. মাসুদ সুলতান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলের এক হাজারেরও বেশি কৃষককে আমরা ২০০ কেজি করে বীজ দিচ্ছি। আমি মনে করি, এগুলো কৃষকের হাতে গেলে বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটা পরিবর্তন হবে। আমরা আলুবীজের চাহিদার খুব অল্পই সরবরাহ করতে পারি।’

দেশের অন্যতম আলু উৎপাদনকারী জেলা জয়পুরহাটে এবার আলুবীজের চাহিদা ৬০ হাজার টন। বিপরীতে মজুদ রয়েছে ৬২ হাজার ৯৫০ টন। চাহিদার তুলনায় জোগান প্রায় তিন হাজার টন বেশি থাকার পরও বাজারে বীজের তীব্র সংকট।

জয়পুরহাট শহরের বিহারিপাড়া বীজপট্টির একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বীজের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। কোম্পানিতে বীজের যে চাহিদা জানানো হয়েছিল সে পরিমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া জেলায় বিএডিসির বীজ বিক্রয় কেন্দ্র না থাকায় ডিলারদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করতে হয়।

পাঁচবিবি উপজেলার দরগাপাড়ার আলুচাষী আবু তাহের বলেন, ‘তিনদিন ঘুরে এক বস্তা আলুবীজও পাইনি। যারা আগে বুকিং দিয়েছেন তারাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না।’ আবার যারা পাচ্ছেন এক বস্তা আলুবীজের জন্য গুনতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা।

এবার দাম বেশি পাওয়ায় অধিক হারে আলু চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। এ তথ্য জানিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভীন জানান, গত বছর খারাপ আবহাওয়া ও দাম ভালো থাকায় কৃষক তাড়াহুড়ো করে আগেই আলু তুলে নেন। এতে প্রায় দেড় লাখ টন ফলন কম হয় জেলায়। এছাড়া পাশের জেলায় জয়পুরহাটের বীজ যাওয়ায় কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে।

সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, প্রতি কেজি বীজআলু ৬৮ টাকায় বিক্রির কথা। অথচ বগুড়ায় গত সপ্তাহে বিক্রি হয় ১০০ টাকা কেজি। এর মধ্যে শহরের বিসিক এলাকার বগুড়া হিমাগার থেকে বলা হয়েছে, তাদের কাছে আর আলুবীজ নেই। বগুড়া শহরের কয়েকটি বীজভাণ্ডারে খোঁজ নিলে জানানো হয়, গত বৃহস্পতিবার তাদের বীজ আলু বিক্রি শেষ হয়েছে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, চলতি বছর সাড়ে ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর জন্য বীজ প্রয়োজন প্রায় ৮৫ টন। সেখানে বগুড়ায় আলুবীজ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার টন। এখনো প্রায় ১৮ হাজার টন বীজ রয়েছে, যা কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাজার কারসাজিতে দাম বেশি হয়।

কুড়িগ্রামে আলুবীজ বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১০০ টাকারও বেশিতে। সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের শুলকুর বাজার এলাকার কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘চরের জমিগুলোয় আগে কোনো আবাদ হতো না। গত বছর বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীরা জমি লিজ নিয়ে আগাম আলু আবাদ করছেন। কিন্তু আমরা সেভাবে আবাদ করতে পারছি না। একদিকে আলুবীজের দাম বেশি, অন্যদিকে সার-কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে। এজন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আলু আবাদ করতে পারছি না। বীজের দাম যদি কেজিপ্রতি ৫০ টাকার মধ্যে থাকত তাহলে আবাদ করা সম্ভব হতো।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর ৭ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য ১২ হাজার টন বীজ প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে বিএডিসিসহ জেলার পাঁচটি হিমাগারে সংরক্ষিত রয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টন। বাকি বীজের চাহিদা কৃষক পর্যায়ে ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকসহ অন্যান্যভাবে সংরক্ষণ করা বীজ থেকে পূরণ হবে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, বাজারে দাম কিছুটা বেশি হলেও আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ সার্বিক বিষয়ে চাষীদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

বীজআলুর সংকট নিয়ে গত ১২ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ে সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সেখানে সরকারি-বেসরকারি খাতসংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বীজ আলুর যথাযথ সংরক্ষণ ও সঠিক হিসাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বীজআলু যাতে অন্য কোনো খাতে ব্যবহার না হয়, সে বিষয়েও কৃষি বিভাগকে তদারকি জোরদারের নির্দেশ দেন।

বীজ সংকট ও উচ্চমূল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী বীজআলু বিক্রি করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’

আরও