পোশাক খাত

ট্রাম্প ঘোষিত অতিরিক্ত ১০% শুল্কভারও নিতে চাচ্ছেন না ক্রেতারা

দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হারে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্কারোপের ঘোষণা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রত্যেক দেশের ওপর বহাল রাখা হয় ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক।

দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হারে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্কারোপের ঘোষণা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রত্যেক দেশের ওপর বহাল রাখা হয় ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। দেশটিতে পোশাক সরবরাহকারী বাংলাদেশী তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে গড়ে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ শুল্ক আদায় করা হতো। এখন পাল্টা শুল্ক বাবদ অতিরিক্ত ১০ শতাংশের ভার এককভাবে ক্রেতারা নিতে চাচ্ছেন না। শুল্কের একটি অংশের ভার তারা রফতানিকারককে বহন করতে বলছেন। ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত শুল্কের পুরোটাই রফতানিকারককে পরিশোধে চাপ দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় করে এমন উল্লেখযোগ্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ওয়ালমার্ট, কোহলস, অ্যামেরিকান ঈগল, গ্যাপ, লিভাইস, টার্গেট, পিভিএইচ, নিউইয়র্কারসহ আরো বেশকিছু ব্র্যান্ড। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঢাকা কার্যালয়ে কর্মরতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শুল্কভার ভাগাভাগির সমঝোতা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কভার সমঝোতা অনুযায়ী পোশাক প্রস্তুতকারকের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে সমঝোতা না হলে চলমান ক্রয়াদেশ জাহাজীকরণ অনুমোদন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে মূল্য কমানোর চাপের পাশাপাশি চুক্তি চূড়ান্ত করার আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না।

বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রেতাদের অধিকাংশই অতিরিক্ত শুল্কভার রফতানিকারকদের ওপর চাপাতে চাইছেন। কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যেমন পিভিএইচ একটি ঘটনায় ১০ শতাংশের মধ্যে ৮ শতাংশ শুল্কভার নিজে বহন করছে, বাকি ২ শতাংশ দিয়েছে পোশাক রফতানিকারকের কাঁধে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্রেতারা নৈতিক ক্রয়চর্চা করছেন না।

হোয়াইট হাউজে ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে বিকাল ৪টায় এ ঘোষণাকালে বাংলাদেশে সময় তখন রাত ২টা। ভোর না হতেই শুল্ক আরোপের প্রভাবসংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশী রফতানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ও অন্যান্য পণ্য আমদানিকারকরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা চলমান ক্রয়াদেশের উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত করতে পরামর্শ দেন।

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশী পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাব নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। উদ্বেগ প্রকাশ করেন জুতা থেকে শুরু করে অন্যান্য পণ্য রফতানিকারকরাও। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের পাশাপাশি শুল্ক আরোপের আওতায় থাকা অন্যান্য দেশও বিভিন্ন পন্থায় শুল্কের প্রভাবমুক্ত হতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে।

৯ এপ্রিল নতুন শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীন ছাড়া বাকি সব দেশের জন্য এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে জানান তিনি। ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেছিলেন, ‘আমি ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করেছি। এ সময়ে পারস্পরিক শুল্কের হার কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববাজারের প্রতি চীনের অবজ্ঞার কারণে আমরা তাদের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করছি। আশা করি, ভবিষ্যতে চীন বুঝতে পারবে যে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে শোষণের দিন শেষ।’

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পোশাক ব্র্যান্ড লিভাইসের স্টোরের অংশীদার প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বৃহৎ পোশাক রফতানিকারকদের অন্যতম। ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বারের কাছে অতিরিক্ত শুল্কের ভার বহনে ক্রেতারা অনুরোধ করছেন কিনা জানতে চাওয়া হয়। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিষয়টি সত্য। এরই মধ্যে ক্রেতারা এমন অনুরোধ করেছেন। অতিরিক্ত শুল্ক ক্রেতাদের ব্যয় বাড়াচ্ছে, ফলে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। অতিরিক্ত ১০ শতাংশ নিয়ে সমঝোতা করছেন। একপর্যায়ে আমাদের ব্যয়ভার বাড়বে। অনেকে ১০ শতাংশের অর্ধেক শেয়ার করতে বলছেন। পোশাক সরবরাহকারীর সক্ষমতা অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত ব্যয়ভারের পুরোটা ক্রেতা একা নিতে চাইছেন না।’

যেহেতু অনেক ক্রয়াদেশের বুকিং আছে, ফলে সমঝোতা ঠিকমতো করতে পারলে অতিরিক্ত শুল্কের সিংহভাগ ক্রেতাকে দিয়ে বহন করানো সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করে এমএ জব্বার বলেন, ‘তবে আমাদের মুনাফা করার সক্ষমতা কমবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় উৎপাদন দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেই জন্য প্রয়োজন হবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইলারদের স্টোরে শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়েছে। পণ্য বিক্রির গতি শ্লথ হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। সবাই কিছুটা রক্ষণশীল হতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে ক্রেতার ভোগব্যয় কমে যাবে। বাংলাদেশের রফতানিকারকদের জন্য চাপ পড়বে পণ্যের দামে। তবে বছর শেষে পণ্যের ভলিউম আগের মতো থাকবে বলে আশা করছি।’

শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পোশাকের রিটেইল স্টোরগুলোতে। চূড়ান্ত ভোক্তারা পণ্য ক্রয়ে রক্ষণশীল হচ্ছেন। আবার সতর্কতার ছাপ পড়েছে রিটেইল স্টোরের গুদাম ব্যবস্থাপনায়ও। শুল্ক বাধার প্রাথমিক ধাক্কা হিসেবে সরবরাহ শৃঙ্খল আর নির্বিঘ্ন বা নিরবচ্ছিন্ন নেই। একদিকে ভোক্তার রক্ষণশীলতা, অন্যদিকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় পণ্যের মূল্য কমানোর জন্য পোশাক প্রস্তুতকারকদের ওপর ক্রেতার চাপ।

স্থগিতাদেশের পাশাপাশি পাল্টা শুল্কের হার ১০ শতাংশ করার পর বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা সমঝোতার সময় পাওয়া গেছে বিবেচনায় কিছুটা স্বস্তিবোধ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাদের স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ পোশাকের ক্রেতারা গড়ে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হারে শুল্কের পর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ হারে আরোপিত শুল্ক পরিশোধে গড়িমসি শুরু করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এককভাবে দিতে চাইছেন না, পোশাক রফতানিকারককে শুল্কের ভাগ বা একটি অংশ পরিশোধ করতে বলছেন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত ১০ শতাংশের পুরোটার ভারই রফতানিকারকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিকারকদের অন্যতম বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ক্রেতা অতিরিক্ত শুল্কভার শেয়ার করতে বলছেন। কোনো কোনো ক্রেতা ৫ শতাংশ, কেউ ২ শতাংশ, যে যেভাবে পারছেন রফতানিকারকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।’

বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিজের অভিজ্ঞতায় এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এক পোশাক আমদানিকারকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত শুল্ক শেয়ার করার প্রস্তাব পেয়েছি, কিন্তু আমি সম্মত হইনি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই এখন অতিরিক্ত শুল্কভার ভাগ (শেয়ার) করে নেয়ার প্রস্তাব করছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অধীন অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটিইএক্সএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৭২৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ২০২৪ সালে যা বেড়ে হয়েছে ৭৩৪ কোটি ৩ লাখ ডলার।

আরও