এবার ঈদ ও সাপ্তাহিক মিলিয়ে নয়দিনের ছুটি পেয়েছেন কর্মজীবীরা। তাই দীর্ঘ ছুটিতে সেবা দিতে বিশেষ শিডিউল করে নিয়েছেন হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীরা। রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের ছুটিতে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি। তবে রোগী ও তাদের স্বজনদের দাবি, সরকারি হাসপাতালে গিয়ে মিলছে সীমিত সেবা। দেয়া হচ্ছে কেবল জরুরি চিকিৎসা।
বহির্বিভাগ বন্ধ থাকলেও জরুরি বিভাগ খোলা থাকবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় যেমন—জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসেও চালছে স্বল্প পরিসরে সেবা কার্যক্রম। রোগীরা অভিযোগ করেন, ঈদের ছুটিতে চিকিৎসক-নার্সদের অনেক সময় পাওয়া যায় না। হাসপাতালের ফার্মেসিগুলোয়ও থাকে ওষুধের ঘাটতি। জরুরি বিভাগেও অনেক সময় চিকিৎসক মেলে না।
স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু কিছু রোগীর তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। যেমন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ক্ষেত্রে। এজন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি অন্য সাধারণ হাসপাতালেও জরুরি সেবা চালু রাখা দরকার। এছাড়া কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগী আছেন, যাদের সপ্তাহে দুই-তিনবার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। মূলত তারাই এ সময় সমস্যায় পড়েন সবচেয়ে বেশি।
কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, ঈদের ছুটিতেও টিকিৎসাসেবা চলবে আগের মতো। জরুরি বিভাগের সব কাজই চলবে। হাসপাতালের সেবাকাজ যাতে বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করতে ঈদের আগে ও পরে সমন্বয়ের মাধ্যমে চিকিৎসক ও নার্সদের ছুটি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে ডায়ালাইসিসের রোগীদের কোনো সমস্যা হবে না। তবে বহির্বিভাগের চিকিৎসা তিনদিন বন্ধ থাকবে।
এর আগে ১৮ মার্চ হাসপাতাল কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ১৬ দফা নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জরুরি বিভাগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি বিভাগ ও লেবার রুম, ইমার্জেন্সি ওটি (জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষ) ও ল্যাব চালু রাখতে হবে সার্বক্ষণিক। হাসপাতালে পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে ঈদের আগে ও পরে সমন্বয় করে ছুটি নির্ধারণের কথাও বলা হয় নির্দেশনায়।
কম খরচে ভালো চিকিৎসাসেবা পেতে অনেকেই রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালকে বেছে নেন। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, সেবার পরিধি থাকায় যেকোনো রোগের চিকিৎসায় ছুটে আসেন সেখানে। তাই ঈদের দীর্ঘ ছুটিকালীন মানুষের সেবা দিতে পর্যাপ্ত জনবল রাখা হয়েছে বলে জানান ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
ঈদকে ঘিরে যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক জানান, ছুটি চলাকালীন প্রতিদিন ১৫০ চিকিৎসক, ৫০০ নার্স ও অন্য কর্মচারী মিলিয়ে এক হাজারের বেশি জনবল নিয়োজিত থাকবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহও নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ডের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালও বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবা দেবে। এজন্য চিকিৎসকরা বিশেষ ডিউটি করে দায়িত্ব পালন করবেন।
জানতে চাইলে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. দেলোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের বহির্বিভাগ শুধু তিনদিন বন্ধ থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচারগুলোও চালু থাকবে। ঈদে যেসব চিকিৎসক ও নার্স সেবা দেবেন তাদের শিফট অনুযায়ী ডিউটি ভাগ করা দেয়া হয়েছে, যাতে ভর্তি থাকা রোগীদের সেবায় কোনো রকমের সমস্যা দেখা না দেয়। এছাড়া আমাদের জরুরি বিভাগের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়ে যায়। তবে চিকিৎসক সংকটের কারণে অনেক সময় আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসা পান না বলেও অভিযোগ আসে। এজন্য স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো তদারক করা জরুরি। সেই সঙ্গে চিকিৎসক ও নার্সদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বহির্বিভাগ কার্যক্রম শুধু তিনদিন বন্ধ থাকবে। এছাড়া বাকি সব আগের মতোই চলবে। জুলাই গণ-অভুত্থানে আহতরা আমাদের এখানে ভর্তি আছেন। তাদের যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকটাও নজরে রাখা হয়েছে। ঈদের দিন তাদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
বিগত ঈদের ছুটিতে কমবেশি অভিযোগ ছিল, রোগীর অবস্থা গুরুতর হলেও নার্স ও চিকিৎসকরা খোঁজ নিতে আসেন না। এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই ঢাকার বাইরের বিভাগীয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয়ও ঈদের ছুটিতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ছুটির দিনগুলোয় যাতে নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসাসেবা পেতে পারে, এজন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগীয় প্রধান ডা. সফুরা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গাইনি বিভাগের চারটি ইউনিটের সঙ্গে কথা বলে সমন্বিত সিদ্ধান্তে ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে বিশেষ করে পাঁচদিন চিকিৎসাসেবা সচল রাখতে ডিউটি রোস্টার তৈরি করা হয়েছে। রোস্টার অনুযায়ী, পর্যায়ক্রমে মিড লেভেল ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া ইউনিটপ্রধানরা যথারীতি রোগী ভর্তি কার্যক্রম শিডিউল অনুযায়ী অব্যাহত রাখবেন। জরুরি চিকিৎসা ও অপারেশনের জন্যও সব ব্যবস্থা থাকবে।’
ঈদের ছুটিতে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউডডোর ছাড়া সব সেবা কার্যক্রম চালু রাখতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জরুরি সেবার সব শাখার পাশাপাশি অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, সিসিইউসহ ভর্তি রোগীর সব ধরনের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতেও সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মশিউল মুনীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক নিয়মেই চালু থাকবে। এজন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের ৩৮২ জনের একটি রোস্টার তৈরি করা হয়েছে। তাদের মাধ্যমেই ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালের সব ওয়ার্ড এমনকি নিয়মিত অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, সিসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস বিভাগের কার্যক্রম সচল থাকবে। শুধু আউডডোরের সেবা বন্ধ থাকবে এ সময়।’
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটার চালু থাকছে ঈদের ছুটিতেও। বন্ধ থাকবে কেবল হাসপাতালের বহির্বিভাগ। এছাড়া প্রায় সব বিভাগ চালু রাখার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, জরুরি বিভাগের সব নিয়মমাফিক অপারেশনসহ হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু থাকবে। কোন কোন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করবেন তার একটি আগাম তালিকাও করা হয়েছে। সে হিসেবে অপরেশন কার্যক্রম চলবে। আর নিয়মিত অপরেশন বা জরুরি নয় তাদের বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বগুড়া প্রতিনিধি আব্দুল আলীম, রংপুর প্রতিনিধি ও বরিশাল প্রতিনিধি