সিপিডির জরিপ

দুর্নীতিকে ব্যবসার প্রধান অন্তরায় ভাবেন দেশের ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী

দেশের ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেব চিহ্নিত করেছেন। এর বাইরে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, মূল্যস্ফীতি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামোসহ ১৬টি অন্তরায় চিহ্নিত করেছেন তারা।

দেশের ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেব চিহ্নিত করেছেন। এর বাইরে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, মূল্যস্ফীতি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামোসহ ১৬টি অন্তরায় চিহ্নিত করেছেন তারা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এক সেমিনারে জরিপটি প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ সংস্কারবিষয়ক এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

প্রধান অতিথি বলেন, ‘বেসরকারি খাতের জন্য কোনো সংস্কার কমিশন নেই। বাণিজ্য সংগঠনগুলো থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাব এলে আমরা এটি বিবেচনা করব এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করব।’

বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আমলাতান্ত্রিক ‘লাল ফিতা’ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এগুলো কমাতে কাজ করছে।’

সেমিনারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে আসা সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) অর্ধেকই পুনর্বিনিয়োগ। প্রকৃত এফডিআই নিম্নমুখী। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত নীতিসহায়তা অপরিবর্তিত রাখার চিন্তা-ভাবনা চলছে।’

বিগত সরকারের শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিকল্পনাকে অর্থহীন উল্লেখ করে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বিদায়ী সরকার ১০৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। তার মধ্যে ৬৮টি সরকারি পর্যায়ে। যদিও এখন পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলও চালু করতে পারেনি। আমরা সরকারিভাবে ১০টির কম, সুনির্দিষ্ট করে বললে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী ও বিধ্বংসী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বৈরাচারী আচরণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ধ্বংস করার জন্য দায়ী। সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে হওয়া উচিত।’

সংস্কারকে চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘সবাই সংস্কার সংস্কার করছেন। কিন্তু কে এটা করবে? অন্তর্বর্তী সরকার? এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বল্পসময়ে একটি রাষ্ট্রের পুরো সংস্কার হতে পারে না। গত ১৩ বছর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থেকে একটি বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা নিয়েছে। তাই সবার আগে রাজনীতির সংস্কার করতে হবে। না হলে চল্লিশ বছরে যা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও তা সম্ভব হবে না।’

সেমিনারে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল সমস্যা দুর্নীতি। ভ্যাট-ট্যাক্স অফিসেই বছরে ২৫-৩০ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয় আমাদের। সেটা আবার দেখানো যায় না। সেজন্য ঘুসের টাকার ওপর আবার কর দিতে হয়।’

বৃত্তের বাইরে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়ে শামীম এহসান বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংস্কার শুরু করা দরকার। নতুন করে কর, ভ্যাট ও কাস্টমসকে সাজাতে হবে। এটা করা গেলে ৫০ শতাংশ দুর্নীতি কমানো যায়।’

এফআইসিসিআইয়ের সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগ আনতে হলে দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। এনবিআর বলছে ট্যাক্স ২৫ শতাংশ, কিন্তু উৎপাদনকরীদের অনেক ক্ষেত্রেই ৪৫ শতাংশের বেশি ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। তবে আমরা যেন মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হই, সেদিকে লক্ষ্য রেখে সংস্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে কোরিয়া মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।’

আমলাতন্ত্রে আমূল পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘‌দেশের মধ্যে সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের সবচেয়ে পণ্ডিত মনে করেন। তবে কাকে কোথায় বসাতে হবে, তারা সেটা জানেন না। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা দরকার। আবার অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করার অপেক্ষায় আছেন। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে বিনিয়োগকারীরা বেশি দিন অপেক্ষা করবেন না; তারা অন্য দেশে চলে যাবেন।’

সেমিনারে জরিপের ফল তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ‘বাংলাদেশে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও প্রক্রিয়ায় সংস্কার’ শীর্ষক এ জরিপ চালানো হয় চলতি বছরের এপ্রিল-জুলাইয়ে। সেবা, শিল্প উৎপাদন, শিল্প অনুৎপাদন এবং কৃষি ও অন্যান্য—এ চার খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নেয়া হয়।

জরিপে বলা হয়েছে, আগামী দুই বছরে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি তৈরি করবে মূল্যস্ফীতি (৩৩ শতাংশ)। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে অর্থনৈতিক মন্দা (১৬ দশমিক ৩ শতাংশ) এবং দারিদ্র্য ও অসমতা (১৩ দশমিক ৩ শতাংশ)। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি সামাজিক ঝুঁকি ধরা হয়েছে বেকারত্বকে (৩০ দশমিক ৭ শতাংশ)। এরপর আছে জ্বালানি সরবরাহের অভাব (২০ দশমিক ৫ শতাংশ); দীর্ঘস্থায়ী রোগ ও স্বাস্থ্যগত জটিলতা (১১ দশমিক ৬ শতাংশ) এবং মানবাধিকার অবক্ষয় (১১ দশমিক ৬ শতাংশ)।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ ও বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল।

আরও