নতুন মাদ্রাসা অনুমোদনের আবেদন বেড়েছে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে মাদ্রাসা স্থাপনের আবেদন এবং নতুন-পুরনো আবেদনে অনুমোদনের পদক্ষেপ গ্রহণ—দুটোই বেড়েছে।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে মাদ্রাসা স্থাপনের আবেদন এবং নতুন-পুরনো আবেদনে অনুমোদনের পদক্ষেপ গ্রহণ—দুটোই বেড়েছে। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের আগে দেশে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আট মাসে নতুন দাখিল মাদ্রাসা স্থাপনের আবেদন হয়েছিল একটি। অন্যদিকে অভ্যুত্থানের পর আট মাসে নতুন মাদ্রাসা স্থাপনের আবেদন করা হয়েছে ১৮টি। এছাড়া অভ্যুত্থানের আগের আট মাসে পূর্ববর্তী সময়ে দাখিল মাদ্রাসাকে আলিম মাদ্রাসায় উন্নীত করার আবেদন ছিল তিনটি, আর পরের আট মাসে আলিম মাদ্রাসায় উন্নীত করার আবেদন ছিল ১২টি।

২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে দেশে নতুন মাদ্রাসা স্থাপন হয়েছিল ৫৪টি। এর মধ্যে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১০টি। আর গত ৫ আগস্টের পর অভ্যুত্থানের আগে-পরে বিভিন্ন সময় করা আবেদনের প্রেক্ষাপটে অন্তত ৮২টি নতুন মাদ্রাসাকে পাঠদানের অনুমতি দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

যেকোনো নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের অনুমতি দেয়ার আগে সংলগ্ন এলাকায় জিপিএস ম্যাপের ভিত্তিতে নিকটতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব পরিমাপ করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড। এজন্য শিক্ষা বোর্ডগুলোর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ জিপিএস ম্যাপ সরবরাহ করে শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, গত চার মাসে ব্যানবেইস এ ধরনের ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জিপিএস ম্যাপ সরবরাহ করেছে। ব্যানবেইসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮২টিই মাদ্রাসা। এর মধ্যে ৫৮টির আবেদন করা হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের পর। এছাড়া এ সময়ে ২১টি সাধারণ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এর সবগুলোই ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন।

মাদ্রাসা শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যুত্থানের আগে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে নানা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। অনেক সময় তাদের সঙ্গে নানা রাজনৈতিক পরিচয়ও জুড়ে দেয়া হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর এ শঙ্কা কমে যাওয়ায় নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষকতা করছেন প্রফেসর মো. আশরাফুল কবির। বর্তমানে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায় কর্মরত আছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় নতুন মাদ্রাসা তৈরির পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আগে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সামাজিক বৈষম্যসহ চাকরির বাজারে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হতেন। এছাড়া অনেক সময় তাদের বিনা কারণেই রাজনৈতিক ট্যাগ দেয়া হতো। ফলে অনেক অভিভাবকই সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তিতে আগ্রহী হলেও কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সামাজিক বৈষম্য বা চাকরির বাজারে বৈষম্যের শিকার হওয়ার শঙ্কা নেই। এছাড়া অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশের বিষয়টিও চিন্তা করেন। মাদ্রাসাগুলোয় শিক্ষার্থীদের ধূমপান বা কোনো মাদকদ্রব্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিষয় নেই এবং সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তারা যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষাও পান। এসব কারণেই মাদ্রাসার চাহিদা বাড়ছে।’

ব্যানবেইসের শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৬। ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে নতুন প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৪৪টি। আর ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার সংখ্যা ১০।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০২৩ সাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মাদ্রাসার আবেদন জমা হতো। তবে এগুলোর বিষয়ে খুব একটা ইতিবাচক ফলাফল আসত না। ২০২৪ সালে নতুন মাদ্রাসার আবেদন সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে অভ্যুত্থানের পর এ চিত্র অনেকটাই বদলেছে। নতুন বেশকিছু আবেদন জমা হয়েছে এবং বোর্ড থেকেও দ্রুততার সঙ্গে এসব আবেদনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা যাচাই, ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় নিকটস্থ মাদ্রাসার দূরত্ব সংগ্রহসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।’

ব্যানবেইসের হিসাবে বিগত বছরগুলোয় মাদ্রাসার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষত করোনার পর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে মাদ্রাসায় ভর্তি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪১ লাখ ২৬ হাজার ৬২৬ জন, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বাধিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি আমরা বেশ আগ্রহ দেখতে পেয়েছি। এর পেছনে মূলত দুটো বিষয় ভূমিকা রেখেছে। একটি হলো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় মাদ্রাসাগুলো কম সময় বন্ধ ছিল এবং আরেকটি হলো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিক শিক্ষাব্যয়। করোনায় অনেক পরিবারে কর্মক্ষম ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছিল এবং অনেক পরিবার নতুনভাবে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এসব পরিবার গ্রামে গিয়ে সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়লেও মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সমাজে কিছু বৈষম্য আগে ছিল। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে এ অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। ফলে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে আগ্রহ আরো বেড়েছে এবং এতে নতুন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগও বেড়েছে।’

দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় দুটো ধারা রয়েছে। একটি আলিয়া ও আরেকটি কওমি। আলিয়া মাদ্রাসাগুলো ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মূল ধারার কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করে। এছাড়া নতুন কোনো আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে হলেও সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং ব্যানবেইসের শিক্ষা পরিসংখ্যানে এসব মাদ্রাসার তথ্য প্রতি বছর হালনাগাদ করা হয়। অপরদিকে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে নেই। এছাড়া এ ধরনের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। দেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম বর্তমানে ছয়টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এসব বোর্ড-সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মনীতি ও মনিটরিং থাকা জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একের পর এক বড় ছুটিসহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ শিক্ষায় আগ্রহ কমছে। তবে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা সংকট হলো এখানে পর্যাপ্ত সরকারি মনিটরিং ও নীতিমালার অভাব আছে, এটি দূর করা প্রয়োজন। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই সরকারের নির্দিষ্ট নীতিমালা ও মনিটরিংয়ের আওতায় আনা উচিত। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে বৈষম্য তৈরি না হয় এবং তারা যেন মানসম্মত শিক্ষা পায় সে ব্যবস্থা করা উচিত। অন্তত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত একই ধরনের শিক্ষা চালু করা উচিত।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মাদ্রাসা পরিদর্শক মো. নাছিমুল ইসলাম বলেন, ‘মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছু বাড়লেও দাখিল পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় বিগত বছরগুলোয় কমেছে। এর কারণ ছিল মাদ্রাসা থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীরা অনেক সময়ই যথার্থ মূল্যায়ন পেত না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে এবং এ কারণে নতুন মাদ্রাসার আবেদনও বেড়েছে। তবে কেউ আবেদন করলেই অনুমতি পাবে বিষয়টি এমন নয়। আমরা সব নিয়মনীতি পর্যালোচনা করে দেখব, যদি প্রতিষ্ঠানটি সবার শর্ত পূরণ করে তবেই তারা অনুমতি পাবে।’

আরও