ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। এজন্য বছরের পর বছর ধরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু আয়, রফতানির তথ্য বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অতিরঞ্জিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান সংশোধন করা হবে বলে প্রত্যাশা ছিল সবার। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও সেই অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যানের কবল থেকে বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। মূলত পরিসংখ্যান তৈরির আগের কাঠামো বহাল থাকার পাশাপাশি অতীতের সব পরিসংখ্যান সংশোধনে সার্বিক উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এ দুটো কারণেই সরকার এখনো আগের অতিরঞ্জিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান থেকে বের হতে পারছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের মান নিয়ে দাতা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন তুলছে। ‘কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম: চেঞ্জ অব ফ্যাব্রিক’ শিরোনামে ২০২২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এতে ১৩০টি দেশের ৩০ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ বলা হলেও এর প্রকৃত হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে ১০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। তাছাড়া সংস্থাটির পরিসংখ্যান সক্ষমতার সূচকেও বাংলাদেশের স্কোর ছিল ক্রমেই নিম্নমুখী।
অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশকের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা থাকে জিডিপির। বৈশ্বিকভাবে জিডিপির অনুপাতের সঙ্গে ঋণ কিংবা রফতানি থেকে শুরু করে রাজস্ব আয়সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নির্দেশকের তুলনা করা হয়ে থাকে। গত দেড় দশকের বিভিন্ন সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেক। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার; সরকারের এ তথ্যটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাদের মতে, দেশের অর্থনীতির আকার ৩০০ থেকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না। এক্ষেত্রে দেশের প্রকৃত জিডিপির পরিমাণ কত সেটি নির্ধারণে গত আট মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অথচ একটি দেশের ঋণের নিরাপদ সীমা কত হবে, রফতানি আয় পর্যাপ্ত কিনা, ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণ হচ্ছে কিনা এসব কিছু পরিমাপ করা হয়ে থাকে জিডিপির অনুপাতে। ফলে জিডিপির তথ্য অতিরঞ্জিত হলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এসব নির্দেশকও ভুল তথ্য দেবে। বিগত সরকার ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রফতানি আয়ের অতিরঞ্জিত তথ্যের কারণে প্রতি বছরই ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) ট্রেড ক্রেডিটে বড় অংকের ঘাটতি দেখা যেত। রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসিত না হওয়ার কারণে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে বিগত সরকারের সময়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট করার চাপ দেয়া হলে সরকারের পক্ষ থেকে এটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে দেখা যায়, হিসাবায়ন পদ্ধতির ত্রুটির কারণে বছরের পর বছর ধরে রফতানির আয় বেশি দেখানো হয়েছে। এ ত্রুটি সংশোধন করার পর সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ হিসাব বছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা রফতানি হয়েছে। যদিও আগের হিসাব অনুসারে এর পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬৩ হাজার ১২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে রফতানি বেশি দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।
রফতানির এ হিসাবের সঙ্গে দেশের জিডিপির আকারও সম্পর্কিত। রফতানি আয় বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ও বেশি দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাব অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে দেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা বা ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। এর আগে বিবিএসের সাময়িক হিসাব অনুসারে জিডিপির আকার ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ কোটি টাকা বা ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির আকার কমেছে ৪৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। সাময়িক হিসাব অনুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও চূড়ান্ত হিসাবে সেটি ৪ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার কারণ হিসেবে বিবিএস বলছে রফতানি আয়ের সংশোধিত হিসাবের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প উৎপাদনের নিম্নগতির প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির তথ্য সংশোধন করা হলেও এর আগের অর্থবছরগুলোর জিডিপির হিসাব এখনো সংশোধন করা হয়নি। মূলত আগের অর্থবছরগুলোর রফতানি আয়ের সংশোধিত তথ্য না থাকার কারণে সংশোধিত জিডিপির হিসাব সম্ভব হয়নি বলে বিবিএস জানিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জিডিপির অনুপাতে কর-রাজস্ব আহরণ বাড়াতে আইএমএফের পক্ষ থেকে সরকারকে চাপ দেয়া হচ্ছে। সংস্থাটির মতে, সরকারের হিসাবে প্রতি বছরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি হলে সে অনুপাতে কর-জিডিপি অনুপাতও বাড়ার কথা। কিন্তু উল্টো সেটি কমছে। বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন কর-জিডিপির দেশ। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অতিরঞ্জিত জিডিপির পরিসংখ্যান সংশোধন করা হলে এর আকার কমে আসবে। তখন কর-জিডিপির অনুপাত বেড়ে যাবে। তবে আকার কমে গেলে সেক্ষেত্রে জিডিপির অনুপাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রমাণভিত্তিক নীতি প্রণয়নের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও শক্তিশালীকরণ—এ বিষয়গুলো খুবই জরুরি। পরিসংখ্যান যেগুলো এখন প্রকাশ পাচ্ছে, তার মান কীভাবে আরো বাড়ানো যায়, নমুনা সংখ্যা কীভাবে আরো বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকারের কাছে পেশ করা শ্বেতপত্রেও আমরা এসব বিষয় উল্লেখ করেছি। সামনে বাজেট আসছে, সেখানে যেন এসব বিষয়ে ভালো বরাদ্দ থাকে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’
বিবিএস উৎপাদন ও ব্যয়ের ভিত্তিতে দেশের জিডিপি হিসাব করে থাকে। সংশোধিত রফতানি আয়ের তথ্য ব্যয়ভিত্তিক জিডিপির হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার পর দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিসংখ্যানগত অসামঞ্জস্যতা ঋণাত্মক ৪৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যেখানে এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক ২৩ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এর আগের দুই অর্থবছরে এর পরিমাণ ধনাত্মক ছিল। জিডিপির হিসাবের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত অসামঞ্জস্যতা ঋণাত্মক হওয়ার মানে হচ্ছে উৎপাদনের ভিত্তিতে জিডিপির আকারের তুলনায় ব্যয়ের ভিত্তিতে জিডিপির আকার কম। দেখা যাচ্ছে জিডিপির আকার সংশোধনের পর পরিসংখ্যানগত অসামঞ্জস্যতার পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে।
দেশের রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ কত সেটি নিয়েও এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ নিজস্ব হিসাবে দেশের গ্রস রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত। কিন্তু আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে রিজার্ভ হিসাবের পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য চাপ দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে গ্রস রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে আসছে। তবে এটিও দেশের প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভকে প্রকৃত রিজার্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। আইএমএফের হিসাব অনুসারে নিট রিজার্ভ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (জিআইআর) থেকে রিজার্ভ সম্পর্কিত দায় বাদ দিতে হয়। রিজার্ভ সম্পর্কিত দায়ের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া এসডিআর বরাদ্দ ও সংস্থাটির কাছে থাকা বাংলাদেশের এক বছরের কম মেয়াদের অনাদায়ী দায় এবং অন্যান্য বিদেশী মুদ্রার দায়, রূপান্তরযোগ্য মুদ্রায় অনিবাসীদের দায়, আকু, জাপান ডেট রিলিফ গ্র্যান্ট (জেডিআরজি) ও বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা দায়, ফরওয়ার্ড কন্ট্রাক্টস, বিদেশী মুদ্রায় সোয়াপ এবং অন্যান্য ফিউচার মার্কেটের কন্ট্রাক্টস-সংক্রান্ত দায়ও এক্ষেত্রে বাদ যাবে। বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ কত সে তথ্য শুধু আইএমএফের কাছে পাঠানো হয়ে থাকে। এর বাইরে এ তথ্য কখনো প্রকাশ করা হয় না। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত এ নীতি এখনো ধরে রেখেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও।
বিগত সরকারের সময়ে জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো হলেও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ভিত্তি বছর পরিবর্তন করার পাশাপাশি পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়। তাছাড়া অনেক অপ্রয়োজনীয় পণ্যও এখানে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। যদিও বিবিএসের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতির হিসাব করার ক্ষেত্রে কোন পণ্যগুলো বিবেচনা করা হয়ে থাকে সে তালিকা প্রকাশ করা হয় না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও মূল্যস্ফীতি হিসাবায়নের ক্ষেত্রে আগের পদ্ধতিই ব্যবহার করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অভিযোগ রয়েছে যে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি স্ফীত করা হয়েছে, বেশি দেখানো হয়েছে। এখন এর ওপর ভিত্তি করে যা-ই করা হোক না কেন, তাতে অর্থনীতির পরিস্থিতি সত্যিকার মূল্যায়ন হয় না। নীতি প্রণয়ন বা অন্য যেকোনো পদক্ষেপ—সব ক্ষেত্রে তথ্য, পরিসংখ্যান হলো মূল ভিত্তি। অবাস্তব, অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে পদক্ষেপই নেয়া হোক না কেন, তার সুফল পাওয়া যাবে না। এজন্যই পরিসংখ্যান ও তথ্যের যথার্থতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পরিসংখ্যান যদি সঠিক না হয়, সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে না।
অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্তের ওপর বেসরকারি খাতকেও নির্ভর করতে হয়। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অতীতে সরকারের দেয়া রফতানি আয়ের অতিরঞ্জিত তথ্যের যথার্থতা নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বারবার প্রশ্নও তোলা হয়েছে। অতিরঞ্জিত তথ্যের কারণে ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিসংখ্যানের ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। আমাদের মাথাপিছু আয়ের সঠিক তথ্য নেই, কর্মসংস্থানের সংখ্যা নেই, এসএমই সংখ্যা নেই, কোন খানে কত কর্মসংস্থান—এগুলোর কিছুরই সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এভাবে কী করে একটি দেশ এগিয়ে যাবে সেটা বোধগম্য নয়। অনুমানের ওপর কোনো কাজ হয় না। দেশীয় বিনিয়োগের জন্য যথার্থ পরিসংখ্যান প্রয়োজন পড়ে, যেমন জনসংখ্যা কত, ভোক্তা কত? কত ব্যয়ের প্রয়োজন হবে, বাজারের আকার কত? এসব পরিসংখ্যান যদি অস্পষ্ট বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন কোনো কাজই সঠিকভাবে এগোনোর সুযোগ নেই। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে সব ধরনের প্রক্ষেপণ করা হয়। সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া এগুলো হয় না। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে সঠিক পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি দুই পক্ষই সঠিক পরিসংখ্যানের ঘাটতিতে ভুক্তভোগী হচ্ছে। সঠিক পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের পথে এগোতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা নিরূপণের জন্য শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করে। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা তিন মাস কাজ শেষে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনেও বিগত সময় পরিসংখ্যান কারসাজির মাধ্যমে উন্নয়নের বয়ান তৈরির অভিযোগ আনা হয়। এতে বলা হয়, ২০১০-১৯ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো হলেও কীসের ভিত্তিতে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। এমনকি একটি মডেলে ২০১৩ সালের পর থেকে দেশের প্রবৃদ্ধি নামতে থাকলেও সরকারের ঘোষিত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃদ্ধির উপস্থাপিত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার এমন ব্যবধান শুধু বাড়ছিল।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সঠিক পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এ বিষয়ে কিছু কাজ হয়তো হচ্ছে। একটা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন নতুন পরিসংখ্যান আইনের কাজ শুরু হয়েছে। যেটা এ সরকারই করে যাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে। অধ্যাদেশের বিস্তারিত না জানলেও এর উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে একটা হলো অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা-সংক্রান্ত। নতুন অধ্যাদেশে পরিসংখ্যান অনুমোদনের জন্য টেকনিক্যাল কমিটি ছাড়া পরিকল্পনামন্ত্রী পর্যায়ে যেতে হবে না। অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে পরিসংখ্যান নির্ণয় হচ্ছে, সেগুলোর ভিত্তি, তথ্য-উপাত্ত, হিসাবের পদ্ধতি এগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকবে, যা অনুসরণ না হলে আইন লঙ্ঘন হবে। সঠিক পরিসংখ্যানের জন্য বিবিএসের স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় বিষয়। বিবিএসকে স্বাধীন করার জন্য অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট ধারা থাকবে। বিবিএস কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে কিনা, সেই বিষয়গুলো এখনো জানা যায়নি। মোটা দাগে জানতে পেরেছি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পথগুলো নতুন অধ্যাদেশে বন্ধ করা হবে। আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে পরিসংখ্যানবিষয়ক একটা অধ্যাদেশ আমরা পাব।’
অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ, অনেক সময় দাবি তোলা হয়েছে যে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা উচিত, যাতে করে সংস্থাটি সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারবে। বিগত সরকারের সময় এটা হয়নি বরং বিভিন্ন তথ্য ম্যানিপুলেট করতে সংস্থাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের সফলতা দেখাতে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে। বিবিএসের তথ্যের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে এ সংস্থাটি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার ওপর ভিত্তি করার উপায়ও নেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলো বিগত সরকারের আমলে পরিসংখ্যানবিষয়ক বিভিন্ন কমিটি হয়েছে। সেসব কমিটিতে বর্তমানে স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ ও অর্থনীতিবিদরাও ছিলেন। তারাই সেসব বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যানের ন্যায্যতা (জাস্টিফাই) নিশ্চিত করেছেন। কাজেই তারাও অতিরঞ্জিত বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যানের দায় এড়াতে পারেন না। কারণ ভুল পরিসংখ্যানের ন্যায্যতা নিশ্চিত করে তারা জাতির ক্ষতিসাধন করেছেন।’
এখন একটা সুযোগ এসেছে পরিসংখ্যান বিষয়ে নতুন করে কাজ করার, কারণ এখন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা (কম্পালশন) নেই—এ মত প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘বাধ্যবাধকতার কারণেই বিগত দিনে শুধু উজ্জ্বল দিকগুলোকে দেখানো হয়েছে। এ ধরনের বাধ্যবাধকতা এখন থাকার কথা না। রাজনীতিবিদরা আগে যেভাবে পরিসংখ্যানকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছেন, সেই প্রচলন থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময়। এ সময়ে যদি আমরা পরিসংখ্যানকে শক্তিশালী, যথার্থ এবং সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে পারি, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে পরিসংখ্যানকে কেউ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। আমার ধারণা একটা স্বার্থের সংঘাত এখানে আছে। যে জন্য পরিসংখ্যান নিয়ে এখনও নীরবতা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্বার্থের সংঘাত আরো জোরালো হয়েছে। এটা যদি না হয় তাহলে কেন সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয়ের বর্তমান সুযোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না?’
পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন নির্দেশক কোথায় দাঁড়াতে পারে সেই প্রক্ষেপণ করা হয়ে থাকে। ফলে সঠিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নীতি কৌশল প্রণয়ন করা না হলে সেটি কাজে আসবে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এ অবস্থায় সঠিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে নীতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সরকারি পরিসংখ্যানের স্বচ্ছতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করা না গেলে কোনো নীতিই কাজে আসবে না।