সমিতির ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতি-মামলা

পল্লী বিদ্যুতের ৫৭ এলাকায় প্রায় তিন ঘণ্টা ব্ল্যাকআউট

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) আওতাধীন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২০ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। চাকরিতে তাদের পুনর্বহালের দাবিতে জেলায় জেলায় ‘ব্ল্যাকআউট’ কর্মসূচি পালন করেন সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) আওতাধীন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২০ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। চাকরিতে তাদের পুনর্বহালের দাবিতে জেলায় জেলায় ‘ব্ল্যাকআউট’ কর্মসূচি পালন করেন সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আরইবির ৮০টি সমিতির অন্তত ৫৭টিতেই গতকাল দুপুর থেকে প্রায় ৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট সমিতির আওতাধীন গ্রাহকরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে। কোনো কোনো জেলায় ৪-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্ল্যাকআউট ছিল বলে জানা গেছে। যদিও পরে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেয়া হলে পুনরায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়।

কার্তিকের এ সময়ে এমনিতেই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এলাকায় ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। দিনের প্রায় সময়ই থাকে লোডশেডিং। এর মধ্যে সমিতির কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকআউট কর্মসূচির কারণে গতকাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ব্যাহত হয় উৎপাদন কার্যক্রম। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ওইসব এলাকার হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা দুর্ভোগে পড়েন।

ব্ল্যাকআউট চলাকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদায় বেশ তারতম্য দেখা গেছে সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) প্রতি ঘণ্টার চিত্রে। গতকাল বেলা ৩টা নাগাদ বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৪৪৫ মেগাওয়াট, বিকাল ৪টায় তা নেমে যায় ৯ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে। বিকাল ৫টা নাগাদ তা আরো কমে ৮ হাজার ৯০৬ মেগাওয়াটে নামে, যেখানে অন্যান্য দিন একই সময় উৎপাদন থাকে সাড়ে ১২ হাজার থেকে প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।

আরইবি অঞ্চলে ব্ল্যাকআউটের বিষয়টি অস্বীকার করেননি সংস্থাটির দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাও। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পল্লী বিদ্যুতের বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরইবি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাদের একটা অংশ দেশের বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় অন্তত ২-৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তবে এটি সব এলাকায় হয়নি। পরে অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর কোনো সমস্যা নেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন কয়েক কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়েন। বিশেষ করে বরিশাল, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাট, দিনাজপুরসহ অন্তত ১৫-২০টি পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। কোনো কোনো জেলায় আরো বেশি সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়নি।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ভংগা গ্রামের মো. তারেক হোসেন বলেন, ‘আমার তিনটি মিটারের আওতায় ডেইরি ফার্ম, মুরগির খামার রয়েছে। এমনিতেই লোডশেডিং হয়, দিনে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এর মধ্যে আবার ব্ল্যাকআউট কর্মসূচির কারণে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এমনটা চলতে থাকলে তো খামার নিয়ে পথে বসতে হবে।’

বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর আওতায় পৌনে চার লাখ গ্রাহক রয়েছে। কর্মসূচির কারণে গতকাল সকাল ৯টা থেকে ওই এলাকায় কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) হুমায়ন কবির বলেন, ‘দেশের ৮০টি স্টেশনের ২০ কর্মকর্তাকে কোনো কারণ দর্শানো নোটিস ছাড়াই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে সকাল ৯টা থেকে বরিশালে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সঙ্গে অভিন্ন সার্ভিস কোড ও অনিয়মিত কর্মচারীদের চাকরি নিয়মিত করার দাবিতে প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু কোনো দাবি পূরণ না করে উল্টো ২০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। চাকরিচ্যুত হওয়ারা মূলত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম), সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) ও জুনিয়র প্রকৌশলী পর্যায়ের কর্মকর্তা। তারা হলেন এজিএম রাজন কুমার দাস, ডিজিএম আসাদুজ্জামান, ডিজিএম দীপক কুমার সিংহ, এজিএম মনির হোসেন, জুনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন, জিএম মো. হুমায়ুন কবির, ওয়ারিং পরিদর্শক আবু সালাম জাবেদ, ডিজিএম মো. রাহাত, এজিএম আবদুল হাকিম, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মো. হাসানুজ্জামান, জিএম মো. মকবুল হোসেন, জিএম মুশফিকুল ইসলাম, জিএম জুলফিকার, জিএম মো. আবুল হাসান, ডিজিএম মো. বেলাল হোসেন, ডিজিএম জাহিদুল ইসলাম, ডিজিএম আবদুল জলিল, এজিএম ইয়াসির আরাফাত ও ডিজিএম সামিউল কবির। বিদ্যুৎ খাত অস্থিতিশীল, বিআরইবির নির্দেশনা অমান্য ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

বরখাস্তকৃতদের মধ্যে মো. মকবুল হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার ও আসাদুজ্জামান নবীনগর সমিতির ডিজিএম। জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নাসিরনগর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. জহিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগেও আমরা বিদ্যুৎ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রেখে আন্দোলন করেছি। তারপরও আমাদের ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাই পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও চাকরি বৈষম্য দূর করতে আমাদের এ আন্দোলন।’

এদিকে গতকালই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক এজিএম প্রকৌশলী রাজন কুমার দাস, ডিজিএম প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া, ডিজিএম দীপক কুমার সিংহসহ সমিতির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এরপর সন্ধ্যায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সমস্যার সমাধান ও আটকদের ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দিলে তারা আগামী রোববার পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করেন।

বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে মাহফুজ আলম বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধের কথা কয়েক জায়গা থেকে বলা হয়েছে। তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে, বসে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাধান করা হবে। আশা করি জনগণের সুবিধার জন্য তারা সেটি মানবেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের আমরা অনুরোধ জানিয়েছি কোনো আন্দোলনে না যেতে। আশা করছি, তারা আলোচনায় বসবেন। আলোচনার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণে কাজ করা হবে।’

প্রসঙ্গত, দেশে বিদ্যুতের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৭২ লাখ। এর মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক আরইবি আওতাধীন পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায়। ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি দেশের বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।

আরও