সুবর্ণচর ও নোয়াখালী সদরের পানিতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে লবণাক্ততা

জলবায়ু অভিঘাতে ক্রমেই দুর্যোগপ্রবণ হয়ে পড়ছে নোয়াখালী

নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচর উপজেলার জনজীবন দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। সুপেয় পানির অভাবে উপকূলীয় এ দুই উপজেলার মানুষ বিপর্যস্ত।

নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচর উপজেলার জনজীবন দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। সুপেয় পানির অভাবে উপকূলীয় এ দুই উপজেলার মানুষ বিপর্যস্ত। একদিকে তীব্র খরা ও বন্যা, অন্যদিকে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশে নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ। বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতাও। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ জলাধার পুনরায় পূরণ না হওয়ায় এ সংকট ভবিষ্যতে আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। অতিবৃষ্টি ও খরার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাবে, যা কৃষি ব্যবস্থা ও প্রাণ-প্রকৃতিকে আরো হুমকির মুখে ফেলবে।

সুবর্ণচরের ৭ নং পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের হাজিপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন মাছ, ধান চাষ, রবিশস্যসহ বিভিন্ন কৃষিকাজে যুক্ত। পানি সংকট ও লবণাক্ততা নিয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে কখনো পানির এমন তীব্র সংকট আমি দেখিনি। কয়েক বছর ধরেই সংকট চলছে, কিন্তু এ বছরের মতো তীব্র ছিল না। কয়েক বছর আগেও আমরা ২৫-৩০ ফুটের মধ্যে কলে পানি পেতাম। এখন ২৫০-৩০০ ফুটেও ঠিকভাবে পানি পাওয়া যায় না। যদিও কোথাও ১০০ ফুটের মধ্যে পাওয়া যায় তবে সেটা লবণাক্ত, পরিমাণেও কম। লবণাক্ততার জন্য কোনো গাছপালা জন্মায় না। চাষাবাদ করা যায় না। এর মধ্যে উড়িরচর, চরমুজিবে সবচেয়ে বেশি লবণাক্ততার সমস্যা।’

পাঁচ বছর ধরে নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচর উপজেলার পানিতে লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানান নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. মহিনুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে আমরা নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর ও সদর উপজেলার পানিতে লবণাক্তের উপস্থিতি লক্ষ করছি। এর অন্যতম কারণ কৃষিকাজের জন্য অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন। কোন এলাকার কোথায় কী পরিমাণ নলকূপ স্থাপন করা প্রয়োজন এটার বিজ্ঞানসম্মত হিসাব আছে। সে হিসাব না মেনেই যত্রতত্র গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। কৃষকরা ইরি ধান চাষের সময় ভূগর্ভস্থ পানি অস্বাভাবিক মাত্রায় তুলে ফেলেন কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জলাশয়, খাল নেই। পর্যাপ্ত বৃষ্টিও হয় না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলার পর ওই খালি জায়গায় নিকটবর্তী সমুদ্রের পানি ঢুকে যায়। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।’

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি নোয়াখালী জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিও স্পষ্ট হয়ে উঠছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিবৃষ্টি, অতিখরা দেখা দেয়। নোয়াখালীতে এখন সেটাই হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরের বন্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। দীর্ঘ খরার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়ছে। আবার যে প্রলয়ংকরী বন্যা হলো সেটাও আমাদের জন্য ক্ষতিকর। অতিবৃষ্টিও পরিবেশের জন্য শুভ নয়। কেননা বৃষ্টি থেমে থেমে হলে সেটা ভূগর্ভস্থ পানিতে সময় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একবারে অনেক বৃষ্টি হলে সেটা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়।’

সুবর্ণচরে নদীভাঙনের কারণে বেশির ভাগ স্লুইস গেট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক স্লুইস গেট অকেজো। ফলে উপজেলার খালগুলোয় পানি জমা থাকছে না। অন্যদিকে স্লুইস গেট না থাকায় অবাধে প্রবেশ করছে নোনাজল। ফলে গভীর নলকূপ বসিয়ে চাষাবাদ করতে হয় কৃষকদের, যা টিউবওয়েলের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এর জন্য অবশ্য সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বে অবহেলাকেও দায়ী করছেন কৃষকরা। পানি সংকট ও লবণাক্ততার প্রভাবে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার মতো নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায়ও শাকসবজি চাষ উল্লেখযোগ্য হারে কমছে।

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সুবর্ণচরে কৃষির আচরণ বদলে যাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রলয়ংকরী বন্যার কারণে আমন ধান নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আগের বছর তরমুজ চাষ করেও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষক। ফলে এ বছর মৌসুম আসার আগেই ইরি ধান চাষ শুরু করেন স্থানীয় কৃষক। ইরি ধানের জন্য পর্যাপ্ত পানি উত্তোলনের জন্য কৃষকরা নিজ উদ্যোগে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী হুমাইস মো. খালিদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণত জানুয়ারির দিকে ইরি রোপণ করা হয়। কিন্তু এ বছর ডিসেম্বরেই কৃষকরা ইরি ধান করেছেন। বৃষ্টির মৌসুম না হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমার আরেকটি কারণ খালগুলো দখল-ভরাট হয়ে যাওয়া। এসব খালে কোনো প্রবাহ নেই। কোথাও পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে খাল-জলাশয়ের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনরায় পূরণ হচ্ছে না।’

বিএডিসির তথ্য বলছে, সুবর্ণচরের চাষাবাদের জন্য ২৪৫টি গভীর নলকূপের (সেচ পাম্প) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর বাইরে চাষীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরো তিন হাজারের বেশি সেচ পাম্প স্থাপন করেছেন, তবে সেগুলো অনুমোদনহীন। গভীর নলকূপ অনুমোদন দেয়ার আগে কোনো গবেষণা হয়নি। মাটির নিচে কী পরিমাণ পানি আছে কিংবা গভীর নলকূপের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। উল্টো সর্বোচ্চ পানি শোষণকারী উফশী জাতের বীজ কৃষকের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সাধারণত নলকূপের গভীরতা হয় ৮০০-৯০০ ফুট, ব্যবহার করা হয় ১ দশমিক ৫ ইঞ্চি পাইপ। কিন্তু সুবর্ণচরের অনেক নলকূপ ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরে বসানো হয়েছে; ব্যবহার করা হয়েছে ৪.৫ ইঞ্চি পাইপ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলার পর সেটা প্রতিস্থাপন হতে বেশকিছু সময় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বৃষ্টি হওয়ার পর আশপাশে খাল-পুকুর ও জলাশয়ে পানি জমে থাকে যা ধীরে ধীরে নিচে গিয়ে জমা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় খাল-জলাশয় ও পুকুর নির্বিচারে ভরাট হয়েছে। এতে শুধু ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার নিচেই নামেনি, বরং ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণও ধীরে ধীরে বেড়েছে। পাশাপাশি নোয়াখালীর কৃষিতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘গত সরকারের আমলে যেসব খাল ও জলাশয় বেদখল হয়েছে, জেলা প্রশাসন এখনো সেগুলো দখল উচ্ছেদ করে প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ফলে নোয়াখালী জেলায় অন্যান্য দুর্যোগের পাশাপাশি অসময়ে জলাবদ্ধতার সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। জলাবদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালীতে ডেঙ্গুর সমস্যাও বেড়েছে। গত কয়েক বছর ঢাকার বাইরে থেকে যেসব ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নোয়াখালী থেকে এসেছে। জলবায়ুর অভিঘাত শুধু ওই এলাকার কৃষিকেই আক্রান্ত করেনি, বরং সব মানুষই এর শিকার। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে দ্রুত খালগুলো খনন করে পানি চলাচল স্বাভাবিক করে দিতে হবে।’

একই কথা বলেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) নোয়াখালী জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন কারণেই আমাদের এখানের খালগুলোর সংযোগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পৌরসভা এলাকায় যে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। আবার দেখা গেছে, নোয়াখালী অংশে খাল খনন করা হয়েছে, কিন্তু লক্ষ্মীপুরে গিয়ে আর খনন করা হয়নি। নোয়াখালী জেলায় বিএডিসি, এলজিইডি, বাপাউবোসহ বিভিন্ন দপ্তরের আওতায় প্রায় খালই খনন করা আছে। খালে প্রবাহও আছে। কিন্তু সংযোগ কোথাও কোথাও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পূর্ণ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া খালে বর্জ্য ফেলা, অবৈধ দখলসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেও জলাবদ্ধতাও তৈরি হচ্ছে। গত বছর যে প্রলয়ংকরী বন্যা হলো সেটার পানি খাল দিয়ে নামতে না পারার কারণে দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নোয়াখালী জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের মধ্যে তীব্র বন্যা, আকস্মিক বন্যাও রয়েছে, যেটা গত বছর আমরা দেখেছি। সুবর্ণচরের দিকে কৃষিকাজের প্রভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানিতে লবণ বাড়ছে।’

আরও