বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে সৃষ্ট সরবরাহ ঘাটতিতে টানা দুই মাস ধরে বাড়ছে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে সরকার। এর পরও বাড়ছে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুই দফায় শুল্ক কমানোর পরও বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারি উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ব্যবসায়ীরা।
৯ অক্টোবর চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক কমানোর ঘোষণায় বাজারদর কিছুটা কমে আসে। একপর্যায়ে পাইকারি বাজারে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনির দাম ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত কমলেও কয়েক দিনের ব্যবধানে ফের বেড়েছে।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দিক থেকে এ পর্যন্ত চিনির দাম বেড়েছে মণে ২০০ টাকারও বেশি। শুল্ক কমানোর ফলে প্রতি কেজিতে দাম ১১-১৪ টাকা কমার সম্ভাবনা কথা থাকলেও মিলগেট থেকে সরবরাহ তুলনামূলক কম হওয়ায় দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল পরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ফিক্সড ট্যাক্স টনপ্রতি ৬ হাজার থেকে কমিয়ে সাড়ে ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে।
এদিকে দেশের বাজারে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। বিশেষ করে এ দুই মাসে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে মণে প্রায় ১ হাজার ১০০ টাকা। মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেলের দাম আর না বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সাধারণত এ ধরনের প্রস্তাবের পর পরই বাজারে দাম কমতে দেখা যায়। কিন্তু বাজারে তা না কমে উল্টো মণপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ অবস্থায় গতকাল ভোজ্যতেল আমদানি, পরিশোধন ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে শুল্ক-করহার কমানোর দুটি আদেশ জারি করে এনবিআর।
ভোজ্যতেলের দাম কমাতে এনবিআরের জারি করা প্রথম আদেশে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন কিংবা পাম অয়েল উৎপাদন এবং ব্যবসায়িক পর্যায়ে প্রযোজ্য মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে। বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের ওপর আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে এনবিআর। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সই করা গতকাল প্রকাশিত দুই পৃথক গেজেটে ভোজ্যতেলে ভ্যাট কমানো হয়েছে।
আরেক আদেশে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন কিংবা পাম অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম কমানোর পৃথক দুটি আদেশের পরও পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। মূলত দীর্ঘমেয়াদে উত্তোলনযোগ্য ভোজ্যতেলের (সরবরাহ আদেশ বা এসও) দাম মণপ্রতি অন্তত ১০০ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্যে জানা গেছে, শুল্ক কমানোর পরও চিনির দাম বেড়ে মণপ্রতি সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৫৩০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। বিশেষ করে সরাসরি উত্তোলনযোগ্য (মিলগেটে দুই-তিনদিনের সিরিয়াল) চিনি শুল্ক কমানোর পরও বাড়তি দাম দিয়ে লেনদেন হচ্ছে। তবে ১০-১২ দিন কিংবা সরবরাহের নিশ্চয়তাহীন চিনির এসও বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১০০ টাকা কম দামে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চিনি সরবরাহে ধীরগতির কারণে বাজারে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে গতকাল সকালে ভোজ্যতেল আমদানি ও বিপণনে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও একই দিনে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে মণে অন্তত ৪০-৪৫ টাকা। বুধবার রাত পর্যন্ত পাইকারি বাজারে মণপ্রতি পাম অয়েল লেনদেন হয়েছিল ৫ হাজার ৮৯০ থেকে ৫ হাজার ৯০০ টাকায়। গতকাল দুপুরের মধ্যে তা কয়েক মাসের মধ্যে রেকর্ড ৫ হাজার ৯৪৫ টাকায় উঠে যায়। যদিও সন্ধ্যায় দাম কিছুটা কমে ৫ হাজার ৯২০ থেকে ৫ হাজার ৯৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে পণ্যটি। একসময় চট্টগ্রামের একাধিক মিল থেকে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল সরবরাহ থাকলেও বর্তমানে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকারকরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের ভোজ্যতেল ও চিনির ব্যবসা কিছুটা কমেছে। এছাড়া ঢাকাভিত্তিক বেশ কয়েকটি ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক অস্থিতিশীলতায় বাজারে প্রয়োজন অনুপাতে সরবরাহ কমে গেছে। অন্যদিকে গ্রুপগুলোর মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে দ্রুত ও সহজে আমদানি ঋণপত্র খোলার সুযোগ থাকায় সরবরাহ ব্যবস্থাপনাও ছিল অনেকটা স্বাভাবিক। ডলারের মান বৃদ্ধিজনিত সংকটের পর বর্তমানে ব্যাংকের তারল্য সংকট, সরকারি পর্যায়ে তদারকির কারণেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভোজ্যতেল ও চিনির ব্যবসা নিম্নমুখী হয়েছে। এসব কারণে বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের বুকিং বেড়েছে, এটা সত্য। তবে আমাদের দেশে বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে আমদানি কম। মিলগুলো থেকেও সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে শুল্ক কমানোর ঘোষণা এলেও দাম উল্টো বেড়ে যাচ্ছে। শুল্ক কমানোর পাশাপাশি আমদানি জটিলতা দূর করা এবং মিলগেট থেকে দ্রুত ভোজ্যতেল সংগ্রহের ব্যবস্থা নেয়া না হলে ভোজ্যতেলের দাম কমানো সম্ভব নয়।’
খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এসও, স্লিপসহ বিভিন্নভাবে ভোজ্যতেল ও চিনি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু রেডি পণ্যের সরবরাহ কম, দামও বেশি। মিলগেট থেকে সরাসরি উত্তোলনযোগ্য পণ্য সরবরাহ কম থাকায় শুল্ক কমানোর ঘোষণা সত্ত্বেও প্রভাব পড়ছে না। তাছাড়া দেশের প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও চিনি-ভোজ্যতেলের বাজার প্রভাবিত করছে। এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে সরাসরি আমদানি কিংবা মিলমালিকদের পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানির ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা উচিত বলে জানিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কয়েক মাসে পাম অয়েলের বুকিং অনেক বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। চিনিও কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে কিনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমানোর দিকে হাঁটছে। এটা ভালো উদ্যোগ হলেও চাহিদা অনুপাতে পর্যাপ্ত আমদানি না হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে একসঙ্গে পর্যাপ্ত আমদানি করতে পারছেন না। দেশের গুটিকয়েক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল ও চিনির ব্যবসায় যুক্ত থাকায় সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সিঙ্গেল ডিজিট এক্সপোজার লিমিট বাড়িয়ে সরবরাহ বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া উচিত।’
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও এসও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রধান পাইকারি বাজারগুলোয় শুল্ক কমানোর ঘটনায় দামে প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু চাহিদামতো সরবরাহ না থাকায় চিনি ও ভোজ্যতেলের শুল্ক কমানো হলেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বরং শুল্ক কমানোর এক-দুদিনের মধ্যে দুটি পণ্যের দামই উল্টো বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার পরিশোধন মিলগুলো থেকে আগের মতো পর্যাপ্ত সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের উচিত পর্যাপ্ত আমদানির মাধ্যমে মিল পর্যায়ে সিরিয়ালবিহীন সরবরাহ নিশ্চিত করা। না হলে আসন্ন শীত ও আগামী বছরের রমজানে ভোগ্যপণ্যের বাজার আবারো অস্থির হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।