সরকার চলতি অর্থবছরের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করেছিল। যদিও অর্থ সংকটের কারণে এবার তার আকার কমানো হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয়েও কাটছাঁট করা হয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে প্রকল্পের জন্য রাখা থোক বরাদ্দ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জিং এ সময়ে বিশ্লেষকরা অবশ্য সরকারি ব্যয়ে আরো রাশ টানার পাশাপাশি আগামী অর্থবছরে বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সম্প্রতি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ চূড়ান্ত করেছে। এতে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দেনা পরিশোধ এবং সমন্বয় বাদে সরকারের পরিচালন ব্যয় হবে মোট ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। মূল বাজেটে যা ছিল ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয় কমেছে ২৯ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৬ কোটি টাকা, যেখানে মূল বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ব্যয় কমেছে ১৭ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা, যেখানে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ছিল মূল বাজেটের আকার। এক্ষেত্রে বাজেটের আকার কমেছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বছর যখন বাজেট ঘোষণা হয়েছিল তখন এটিকে উচ্চাভিলাষী মনে হয়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক বড় বাজেট এবং ধারণা করা হয়েছিল যে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। প্রতি বছরই একই অবস্থা দেখা যায়, ঘোষিত বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেট কমে যায় এবং প্রকৃত বাজেট আরো কম হয়। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেটিও কিন্তু পূরণ হবে না। অন্যদিকে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে এ কারণে টাকা ছাপিয়ে অর্থায়নও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে ব্যয় কাটছাঁট করা হবে, যেখানে বেশি ব্যয় করার কথা।’
তিনি বলেন, ‘বাজেট প্রণয়নের সময় আমরা বলেছিলাম, এর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল অর্থনীতিকে সুসংহত করা এবং এক ধরনের স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা। বিশেষ করে যখন সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ আছে। সেদিকে নজর না রেখে বরং একটি উচ্চাভিলাষী বাজেট দেয়া হয়, যেখানে বড় ধরনের বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলোও অবাস্তব মনে হয়েছে। এগুলো কোনোভাবেই এ অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বাজেট বাস্তবায়নের হারও অনেক দুর্বল।’
এদিকে প্রত্যেক খাতের বিপরীতে সংশোধিত বরাদ্দের অতিরিক্ত কোনো ব্যয় বিল গ্রহণ না করার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি অর্থ বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগ থেকেই কেবল যেসব খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হবে সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে। বাস্তবায়নাধীন অনুমোদিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকারি (জিওবি) অংশের বরাদ্দের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগ ও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কোনো সম্মতির প্রয়োজন হবে না। এ অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাড় হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং প্রকল্প পরিচালকরা তা সরাসরি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে সংশোধিত অননুমোদিত প্রকল্পসহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগের জারি করা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থ অবমুক্তি ও ব্যবহার নির্দেশিকা ২০১৮-এর বিদ্যমান পদ্ধতি অপরিবর্তিত থাকবে।
প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে মূল মঞ্জুরির পরিমাণ সংশোধিত বরাদ্দ থেকে বেশি এবং এরই মধ্যে সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় বেশি অর্থ ছাড় কিংবা ব্যবহার হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় যে পরিমাণ অর্থ বেশি ছাড় বা ব্যবহার হয়েছে, তা অবিলম্বে সমর্পণ কিংবা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। অর্থ জমা দেয়ার বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে এ বছরের জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে অর্থ বিভাগকে জানাতে বলা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট যাতে বাস্তবভিত্তিক হয় সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলো মোকাবেলার দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকতে হবে। সরকারি ব্যয়ের অনেক ক্ষেত্রে কাটছাঁটের সুযোগ আছে। অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো সম্ভব। সংশোধিত বাজেটে থোক বরাদ্দ যে বাদ দেয়া হয়েছে এটি ভালো সংবাদ। এটি একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ছিল বাজেটে। বড় বড় উচ্চাভিলাষী যে প্রকল্প এখন না করে পরেও বাস্তবায়ন করা যায়, সেটি যেন আগামী বাজেটে প্রতিফলিত হয় সে প্রত্যাশা থাকবে।’
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার মধ্যে প্রথম ছয় মাসে এর ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। এ সময়ে মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন খাতে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা ও উন্নয়ন খাতে ৪৩ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। যদিও এটি সংশোধন করে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ৭১৫ কোটি টাকার রাজস্ব। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এবারো মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পাওয়া অর্থ ব্যয় করতে না পারায় কাটছাঁট করতে হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ। ফলে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি বা আরএডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়। এর আগে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা, যেখানে থোক বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকার। সংশোধিত এডিপিতে থোক বরাদ্দ বাদ দেয়া হয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজেটের আকার যে পরিমাণ কমানো হয়েছে সেটি বাস্তবসম্মত, তবে পর্যাপ্ত নয়। এটি কমপক্ষে ১ লাখ কোটি টাকা কমানো উচিত ছিল। এনবিআরের সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিও অর্জিত হবে না। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে এক্ষেত্রে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি থাকবে। এতে অর্থায়ন নিয়ে সরকারের টান আরো বাড়বে। বাজেটের আকার ৪৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির কারণে প্রকৃতপক্ষে বাজেটের আকার কমবে ১৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকারের স্থানীয় উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যার বড় অংশই এখনো নেয়া হয়নি। পাশাপাশি বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বড় ঘাটতি থাকবে। এতে স্থানীয় উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চাহিদা আরো বাড়বে। এ ঘাটতি মেটাতে সরকার যদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তাহলে মুদ্রা বাজারের ওপর চাপ বাড়বে এবং এতে ট্রেজারি বিলের সুদের হারও অনেক বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় সরকারি ব্যয়ে আরো কাঁটছাট করতে হবে।’