বান্দরবানে সুপেয় পানি সংকটে বাড়ছে ডায়রিয়ার ঝুঁকি

বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় বন উজাড় হওয়ার কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো।

বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় বন উজাড় হওয়ার কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো। যদিও প্রযুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে পানির চাহিদা মেটানোর কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে স্থাপন করা পানি প্রযুক্তিগুলোর বেশির ভাগ টেকসই না হওয়ায় এবং জনসংখ্যা অনুপাতে পানির পর্যাপ্ত উৎস না থাকায় সংকট কাটেনি। এ বাস্তবতায় দুর্গম এলাকার মানুষ খাল, ঝিরি ও ঝরনার দূষিত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে পানিবাহিত রোগ, বিশেষ করে ডায়রিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে সেখানকার বাসিন্দাদের। অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসা না পেয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তবে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ মোকাবেলা ও মৃত্যু রোধে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।

দুর্গম অঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে উৎসগুলোর পানি কমে যায়। তখন উৎসগুলোর পাশে বাধ্য হয়ে কূপ খনন করে পানি সংগ্রহ করে তারা। তবে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলোয় দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় বিকল্প উৎস না থাকায় দূষিত পানি পান করার কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় অনেকে।

বান্দরবান স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুনে আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নের ১০-১২টি পাড়ায় শিশুসহ দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। সে সময় ওই ইউনিয়নে তিনদিনে সাতজনের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের জুনে থানচি উপজেলার রেমাক্রি ও কুরুকপাতা ইউনিয়নের দুর্গম কয়েকটি পাড়ায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়। ওই সময় দুই ইউনিয়নে শিশুসহ দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। সর্বশেষ মঙ্গলবার সকালে আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নে ডায়রিয়ায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো।

তবে পুরো ইউনিয়নে সুপেয় পানির কোনো উৎস নেই বলে জানিয়েছেন রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেমাক্রি ইউনিয়ন পাথুরে এলাকা দাবি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে ইউনিয়নে সুপেয় পানির কোনো প্রযুক্তিও নেই। গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নিলে নৌকাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত রয়েছে ইউনিয়নবাসী। গত ১৫ বছরে ইউনিয়নের ৯১টি পাড়ার মধ্যে ৩৫টি পাড়ায় গ্র্যাভিটি ফ্লো সিস্টেম (জিএফএস) পানি প্রযুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে জিএফএসের পানি নিরাপদ নয়। কারণ এতে কোনো ফিল্টারিং ব্যবস্থা নেই। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) মিলে স্থাপন করা ৩৫টি জিএফএসের মধ্যে ২১টি অচল পড়ে রয়েছে।’

জিএফএস ছাড়া অন্য কোনো পানি প্রযুক্তি নেই বলে জানিয়েছেন আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নের ১৩৫টি পাড়ার মধ্যে ১৫ বছরে ৫০টি পাড়ায় জিএফএস স্থাপন করেছে সরকার। এর মধ্যে সড়ক নির্মাণের সময় য়াংরিং পাড়ায় জিএফএসের পাইপ কাটা পড়ে বর্তমানে অকেজো হয়ে রয়েছে। এছাড়া কয়েক বছর আগে জিরাপাড়া, ক্রংলেং পাড়া ও জমিরাম পাড়ায় বেসরকারি একটি সংস্থার উদ্যোগে স্থাপন করা রিংওয়েল সচল রয়েছে। তবে গত বছর থেকে প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে গত বছর ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপও কমেছে।’ তার পরও সুপেয় পানি সংকটের কারণে দুর্গম এলাকা ঝুঁকিমুক্ত নয় বলেও জানান তিনি।

সরজমিন দেখা গেছে, সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের আমতলী মারমা পাড়ায় দুটি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে একটি অচল। অন্যটিতে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। এ কারণে লামা-সুয়ালক সড়কের পাদদেশে প্রবহমান সুয়ালক খালের পাড়ে কূপ খনন করে সুপেয় পানি সংগ্রহ করছেন সেখানকার নারীরা। তিন বছর ধরে আবেদন করেও পানি প্রযুক্তি পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সুয়ালক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা।

তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুয়ালক ইউনিয়নে ৫০টি পাড়ার মধ্যে ২৫টিতে পানি প্রযুক্তি নেই। ইউনিয়নটিতে গভীর নলকূপ স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। কারণ একটি বৌদ্ধবিহারে ৭৪২ ঘনফুট ও আমতলী পাড়ায় ২৫০ ঘনফুট পর্যন্ত মাটির গভীরে খুঁড়েও পানি পাওয়া যায়নি। এ বাস্তবতায় তিন বছর ধরে ইউনিয়নবাসীর জন্য রিংওয়েলের আবেদন করলেও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সাড়া দেয়নি।’

অবশ্য দুর্গম এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয় বলে জানিয়েছেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মোজাম্মেল হক বাহাদুর। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না, সেখানে রিংওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে সমন্বয় করে দুর্গম এলাকার মানুষের হাতে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পৌঁছার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। সেসব এলাকার জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এটি চূড়ান্ত অনুমোদন হলে দুর্গম এলাকার মানুষের সুপেয় পানির সংকট দূর হবে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপও কমে আসবে।’

বর্ষা মৌসুমের শুরুতে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ মোকাবেলা করতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রচুর স্যালাইন মজুদ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্গম এলাকার জনবসতিগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে উঠানবৈঠকসহ জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। গত মাসিক সভায় দুর্গম এলাকার লোকালয়ে অন্যান্য বছরের মতো ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে মৃত্যু ঠেকাতে নির্দেশ দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর উশৈসিং। পানিবাহিত রোগের প্রকোপ মোকাবেলায় ও মৃত্যু রোধে স্বাস্থ্য বিভাগের পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও রয়েছে।’

আরও