কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের আলী আহমদ তার দুই ছেলেকে নিয়ে প্রায় ২০ বছর ধরে লবণ চাষ করে আসছিলেন। দুই হাজার শতক (২০ একর) লবণ মাঠ ইজারা নিয়ে লবণ চাষ করলেও গত দুই বছর আগে এ পেশা ছেড়ে স্থানীয় বাজারে মুদির দোকান দিয়েছেন তিনি। আর দুই ছেলে এখন অটোরিকশা চালান। লবণের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, খরচের তুলনায় দাম অর্ধেকে নেমে যাওয়া, ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়ায় লবণ চাষ ছেড়েছেন তারা। স্থানীয় বাজারে বসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আলী আহমদের। তিনি জানান, এ এলাকার বেশির ভাগ লবণ মাঠের মালিক মহাজনরা। তাদের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে চাষ করেন চাষীরা। আর নগদ অর্থের জোগান দেয় আরেকটি পক্ষ। লবণের মাঠ ইজারা নেয়ার সময় কিছু টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ টাকার জন্য কৃষকরা স্থানীয় বিত্তশালীদের কাছ থেকে ঋণ নেন। কিন্তু মৌসুম শেষে সে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে এ পেশায় কে থাকবে! আলী আহমদ বলেন, ‘আমি যখন লবণ চাষ শুরু করি তখন পুঁজি লাগত কম কিন্তু উৎপাদন বেশি হতো, বিক্রি করে লাভ হতো। সেই সময় মণপ্রতি ৩০-৪০ টাকা লাভ হতো। মৌসুম শেষে ৫০ হাজার টাকার ওপরে লাভ থাকত। কিন্তু এখন উল্টা লাখ টাকা লোকসান হয়।’
চকরিয়া উপজেলার লবণ চাষী জয়নাল। করোনার পরে তিনি আর লবণ চাষে ফেরেননি। এখন তিনি দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের চাহিদা অনুযায়ী লবণ উৎপাদিত হলেও চাষী ন্যায্যমূল্য পান না। এ লবণ শহরে বিক্রি হয় কেজি ৪০ টাকায় অথচ আমরা ৪ টাকাও পাই না। আবার লোন নিতে গেলে ব্যাংক লোন দেয় না। আবার লবণ বিক্রির সময় মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের প্রতি মণের অর্ধেক টাকা দিতে হয়। এ পরিস্থিতির কারণে এখানকার চাষীদের অধিকাংশই ঋণগ্রস্ত।’
বিসিকের তথ্যমতে, দেশের মোট লবণ উৎপাদনের ৮৭ শতাংশ হয় কক্সবাজার জেলার ৯টি উপজেলায়। বাকিটা আসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে। দেশে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে লবণের উৎপাদন বাড়লেও ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি চাষীদের। এবার মৌসুমের শুরুতে মাঠের লবণ মণপ্রতি ৩০০ টাকার ওপরে বিক্রি হলেও বর্তমানে মৌসুমের মূল সময়ে দাম কমে এসেছে উৎপাদন খরচের অর্ধেকে। এভাবে প্রতি বছর লোকসান দিয়ে ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন অনেক চাষী। ঋণমুক্ত হতে তারা বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা।
টেকনাফের সরোয়ার কামাল এ বছর ২ হাজার ৮০০ শতক মাঠে লবণ চাষ করেছেন। প্রতি শতকে উৎপাদিত হবে গড়ে ২৮০ মণ লবণ। ২০০ টাকা ধরে যার বর্তমান বাজারমূল্য ৫৬ হাজার টাকা। কিন্তু এ লবণ উৎপাদনে মাঠ ইজারা, পলিথিন, পানি বাবদ তার খরচ হয়েছে শতকপ্রতি প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। এছাড়া দুই ধাপে শ্রমিকের মজুরি গুনতে হয় ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা। ফলে প্রতি শতক লবণ উৎপাদনে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ১৪ হাজার টাকা। এবার মৌসুমের শুরুতে মণপ্রতি ৩২০-৩৫০ টাকা দাম থাকলেও মার্চ-এপ্রিলে এসে দাম কমে ১৫০-২২০ টাকায় নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের থেকে আগে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তিনি। ফলে ভবিষ্যতে লবণ চাষ অব্যাহত রাখা নিয়ে শঙ্কা তার।
সরোয়ার কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৌসুমের মূল সময়ে এসে হঠাৎ দাম কমে গেছে। গত বছর এ সময়ে (মার্চ-এপ্রিলে) প্রতি মণ লবণ ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা এবং ২০২৩ সালে ৪০০ টাকার ওপরেও বিক্রি করেছি। কিন্তু এ বছর পুরনো সিন্ডিকেট আবার ফিরে এসেছে। আমরা কীভাবে চাষ করব আর কীভাবে বিক্রি করে মুনাফা পাব? এভাবে চলতে থাকলে আগামী বছর আমাকে ১২০০ শতকে নেমে আসতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর হয়তো আমাদের কাফনের কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।’
চকরিয়ার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের ক্ষুদ্র লবণ ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিন এবার ২৪০ শতক জমিতে লবণ চাষ করেছেন। শুরুতে মণপ্রতি ৪০০ টাকা দরে লবণ বিক্রি করলেও এখন সে দাম নেমে এসেছে ১৫০ টাকায়। যার মধ্যে দালালকে (মধ্যস্বত্বভোগী) দিতে হচ্ছে প্রায় অর্ধেক। তিনি জানান, ‘লবণ বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা পেলে দালালকে দিতে হচ্ছে আড়াই হাজার টাকা।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে চাষীদের জন্য ব্যাংক লোন নেই। নিজের জমি না থাকলে লবণ চাষ করে কেউ লাভবান হতে পারছে না। এভাবে চললে সামনে অন্য পেশায় যেতে হবে।’
শুধু আহমদ আলী, জয়নাল, সরোয়ার, হেলাল নন, কক্সবাজার জেলার নয়টি উপজেলা ও বাঁশখালীর প্রান্তিক লবণ চাষীদের চিত্র প্রায় একই রকম। বিসিকের মতে, লবণ চাষে এখনো আসেনি উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া।
স্থানীয়রা বলছেন, লবণ উৎপাদনে লোকসান গুনতে হলেও এসব জমিতে অন্য ফসল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে চাষীরা লবণ চাষ করছেন। চকরিয়া ও মহেশখালীর অন্তত ১০ জন লবণ চাষী জানিয়েছেন, লবণ চাষ তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পেশা। যেসব মাঠে লবণ চাষ হয় সেখানে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। এসব মাঠ লবণাক্ত থাকে। যার কারণে অনেক চাষীকেই এ পেশায় থাকতে হচ্ছে।
চাষীরা ন্যায্যমূল্য না পেলেও দেশে লবণের উৎপাদন বাড়ছে। বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১৯৬০-৬১ মৌসুম থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয় এ অঞ্চলে। সে বছর ৬ হাজার ৭৭৪ একর জমিতে ১ দশমিক ২১ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়। বর্তমানে দেশের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদন থেকেই। ২০২১-২২ মৌসুমে ২৩ দশমিক ৩৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ দশমিক ৩১ লাখ টন। ২০২২-২৩-এ ২৩ দশমিক ৮৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে ২২ দশমিক ৩২ লাখ টন এবং ২০২৩-২৪ মৌসুমে ২৫ দশমিক ২৮ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে ২৪ দশমিক ৩৮ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। ২০২৪-২৫ মৌসুমে চাহিদা ধরা হয়েছে ২৬ দশমিক ১০ লাখ টন। এরই মধ্যে ১৭ লাখ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে উৎপাদন।
লবণের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে চাষীদের খরচও। ২০২৪-২৫ মৌসুমে জমির ইজারা, পলিথিন, শ্রমিক, পানি বাবদ এক মণ লবণ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৫০ টাকা। তার মধ্যে জমির ইজারা বাবদ ২০০ টাকা, পলিথিন, পানি ও সেচ বাবদ ২০ টাকা এবং দুই ধাপে শ্রমিক বাবদ ১৩০ টাকা খরচ হয়। গত তিন বছরের তুলনায় এবার ২৯ টাকা খরচ বেড়েছে মণপ্রতি। বিসিকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪-এ প্রতি মণ উৎপাদনে খরচ ছিল ৩২১ টাকা, ২০২২-২৩-এ ২৭০ টাকা এবং ২০২১-২২-এ ২৬৩ টাকা। উৎপাদন খরচ বাড়লেও এ সময়ে (মার্চ-এপ্রিল) বর্তমানে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকায়, ২০২৩-২৪-এ ২২০-২৫০ টাকা, ২০২২-২৩-এ ছিল ২৮০-৩০০ টাকা।
এ বিষয়ে চাষী ও ব্যবসায়ীরা জানান, ‘জমির ইজারামূল্য বৃদ্ধি, সেচ ব্যবস্থা এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেশি পড়ছে।’ আগে চাষীরা আদি পদ্ধতিতে সেচ দিলেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বৈদ্যুতিক মোটর, যা উৎপাদন খরচ আরো বাড়াচ্ছে।
কক্সবাজার লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জামিল ইব্রাহিম বলেন, ‘সারা দেশের লবণের চাহিদা পূরণ করছে কক্সবাজার। অথচ আমাদের জন্য নেই কোনো ঋণ, আর্থিক প্রণোদনা। এখনো গত মৌসুমের ১০ হাজার টন লবণ মজুদ আছে, যা কম দামে ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। চাষীরা দাম না পেলেও মিল মালিকরা ঠিকই ব্যবসা করছে। কিছু সিন্ডিকেট এ ব্যবসাটাকে নিচের দিকে টেনে ধরছে। আমরা এ নিয়ে আন্দোলনও করেছিলাম। উপদেষ্টা বরাবর চিঠিও দিছি। গত সরকারের আমলে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে একটা কৃত্রিম সমস্যা তৈরি করা হতো। এবারো শুনছি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্টের নামে আমদানি করা হবে। আমাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন থাকার পরও আমদানি করা হলে এবারো লবণ চাষী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসবে না।’
লবণ চাষীদের বার্ষিক বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে বিসিক। ২০২২-২৩-এ ১১৩ জনকে ৫০ হাজার টাকা করে ৫৬ দশমিক ৫০ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪-এ ১৩১ জনকে ৬৫ দশমিক ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ মৌসুমের ঋণ দেয়া হবে এ মাসে। তবে এসব ঋণের অর্ধেকই পরিশোধ করতে পারেননি চাষীরা। এ বিষয়ে বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, ‘বিসিক থেকে প্রতি বছর কিছু চাষীকে বিশেষ ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু লবণের দাম কম থাকায় সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না চাষীরা। এখন আমরা এ বিষয়ে ঋণখেলাপির মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ মামলার বিষয়ে বিসিকের লবণ সেলের প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত। তাই মামলার বিষয়টি সহজভাবে দেখার চিন্তা করছি।’ তিনি জানান, লবণ চাষীদের ব্যাংক ঋণের সুযোগ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চাষীরা লবণের দাম পাচ্ছেন না। বিষয়টি নিয়ে আমরাও শঙ্কিত। দাম কমার কারণ হচ্ছে ভোজ্য লবণের চাহিদা শিল্প খাতে কমে গেছে। আমদানীকৃত লবণের দাম কম হওয়ায় দেশী লবণের চাহিদা তৈরি হচ্ছে না। ফলে লবণ মিল মালিকরা উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন। লবণ উৎপাদন বাড়ছে সেটি সত্য। এবার সরকার ভাবছে কয়েক হাজার টন লবণ অগ্রিম কেনার, যেন চাষীরা দামটা পান। আবার চাষীদের প্রণোদনার আওতায় আনার কাজ করছি। কারণ তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত।’
সোডিয়াম সালফেট আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সোডিয়াম সালফেট গার্মেন্টস শিল্পের জন্য আনা হচ্ছে। এর কারণ ওটার দাম কম। এটাতে যেন ট্যারিফ বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাহলে আমদানিতে খরচ বেশি পড়বে। তখন তারা স্থানীয় লবণ নেবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।’