২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে এসে অবতরণ করে বিশেষ এক উড়োজাহাজ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও তার সফরসঙ্গীদের বেইজিং থেকে বয়ে নিয়ে এসেছে উড়োজাহাজটি। বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের পর উড়োজাহাজটিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে বিমানবাহিনীর ফাইটার জেট। মন্ত্রিসভার কয়েক সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানালেন রাষ্ট্রপতি (তৎকালীন) মো. আবদুল হামিদ। ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হলো চীনা প্রেসিডেন্টকে।
তিন দশকের মধ্যে এটিই ছিল চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের প্রথম ঢাকা সফর। শি জিনপিংয়ের সফরটির মধ্য দিয়ে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছায় চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। সফর চলাকালে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ বিলিয়ন (আড়াই হাজার কোটি) ডলারের বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন শি জিনপিং। চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ এক অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তীব্র বৈরিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রশ্নে একই অবস্থান গ্রহণ করে চীনও। পরস্পর বৈরী দেশ দুটির সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বজায় রাখতে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করতে থাকে বাংলাদেশ। বেইজিং পরিণত হয় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বড় এক রাজনৈতিক সমর্থকে। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনীতিকদের বক্তব্যে বিষয়টির প্রতিফলন দেখা গেছে বারবার।
সম্পর্কের এ উষ্ণতার ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহেই চীনে এক রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল দেশটি থেকে এবারো বড় ধরনের বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার ঘোষণা আসবে, সব মিলিয়ে যার সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হচ্ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। যদিও প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর চলাকালে মাত্র ১ বিলিয়ন ইউয়ান অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে চীন সরকার, ডলারে যার পরিমাণ ১৫০ মিলিয়নেরও কম। সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী চীনের ঘোষিত অর্থ সহায়তার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার কিছু বেশিতে।
প্রত্যাশার তুলনায় কম সহায়তার ঘোষণা আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে ভারসাম্য রক্ষা করার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। বরং পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো আঞ্চলিক শক্তির প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে, যার জন্য চীনের কাছ থেকে যে পরিমাণ সহযোগিতা পাওয়ার কথা ছিল তা অনিশ্চয়তার দিকে গেছে। আগামী দিনগুলোয় চীন বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজেক্ট যাচাই করার জন্য আসবে সেই পরিপ্রেক্ষিতে যদি বাংলাদেশ সাহসী অবস্থান নিতে না পারে তাহলে অতীতে যেভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর ঝুলে গেছে, তিস্তা প্রকল্পও সেভাবে ঝুলে যাবে। এখানে আরো একটি বিষয় হলো যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দহরম-মহরম; তাদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যারা অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়ার জন্য বসে আছে, তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক করবে না; সেটা তো হয় না।’
বিষয়টি নিয়ে একই মত পোষণ করছেন ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর (অব.) মনজুর কাদেরও (জাতীয় পার্টির সরকারের আমলের সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী)। তার ভাষ্যমতে, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতমুখী হয়ে গেছে। এখানে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নেই, যার জন্য সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখানে জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি মালদ্বীপসহ ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশেই এখন ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলন চলমান রয়েছে। এসব কিছুর কারণে দেন-দরবার করার জন্য চীন এখন সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চীনকে কখনই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভাবতে হয়নি। কিন্তু মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দেশটির রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে চীন এখন বাংলাদেশের সরাসরি প্রতিবেশী। ভূরাজনৈতিকভাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। তাই চীন এখন শক্ত অবস্থান নেবে। বাংলাদেশ আগের মতো দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারবে না। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ব্যালান্সিং চলে না। একদিকে যেতে হবে। যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।’
শি জিনপিংয়ের সফরের ধারাবাহিকতায় দেশের বেশকিছু মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে যুক্ত হয় চীন। সফর চলাকালে চীনা প্রেসিডেন্ট নিজেই কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্থাপিত টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে অংশ নেন। এছাড়া পরের পাঁচ বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু রেল লিংক (সহায়তার পরিমাণ প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার) এবং বিদ্যুৎ সংযোগ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের (১৪০ কোটি ডলারের কিছু বেশি) মতো বৃহৎ কয়েকটি প্রকল্পে ঋণ দেয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয় চীন। কিন্তু ২০২৩ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশে নতুন কোনো বড় প্রকল্পে সেভাবে চীনা বিনিয়োগ আসেনি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি শূন্য। যদিও এ সময়টিতেই ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানামুখী সংকটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত চীন সফরের মধ্য দিয়ে দেশটি থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়ার নতুন পথ তৈরি হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল।
চীন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান সম্পূর্ণ সঠিক বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে টাকাটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ না। তারা আমাদের অনেক প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে, কিন্তু চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার ভয়ে আমরা সেগুলো নিইনি। এখন পর্যন্ত আমরা ৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি ঋণ নিয়েছি, যা আমাদের জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এ সফরে হাই প্রোফাইল সমঝোতা হয়েছে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া যখনই টাকার প্রয়োজন হবে তখনই আমরা তাদের কাছ থেকে পাব বলেই আমার ধারণা। আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখতে চাওয়ার উদ্দেশ্য থেকে এখানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ হবে, এমন কিছু আমরা চাই না। সে হিসেবে সফরটিকে আমি সফল হিসেবেই দেখছি।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলেনি বলে মনে করছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে সব বিষয় উঠে না এলেও সামনের দিনগুলোয় উঠে আসবে বলে আমার ধারণা। চীন নিজেও আগামী দিনে অনুদান-ঋণ সহায়তা দেয়ার কথা বলেছে। চীন ও বাংলাদেশের যে সম্পর্ক সেখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের জের রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’