উত্তরা-মতিঝিল রুটে (এমআরটি লাইন-৬) মেট্রো ট্রেন পরিচালনা করে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয় করেছে ২৪৪ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ আয় হলেও ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি গত বছর লোকসান গুনেছে ৫২ কোটি টাকার বেশি, যার পুরোটাই খরচ হয়েছে কোম্পানির প্রশাসনিক কাজে। মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প এখনো চলমান। এজন্য ট্রেনের টিকিট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ রাজস্ব আয় হিসেবে দেখাতে পারেনি ডিএমটিসিএল। সংস্থাটির ২০২৩-২৪ হিসাব বছরের প্রকাশিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে টিকিট বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত অর্থকে রাজস্বের বদলে দায় হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্প শেষ হবে ২০২৫ সালে। বর্তমানে এ মেট্রো লাইন নির্মাণের জন্য গৃহীত ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদ্যুৎ বিল, লাইসেন্স ফিসহ ট্রেন পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় প্রকল্প থেকে নির্বাহ করা হচ্ছে। এ কারণে গত অর্থবছরে মেট্রোরেল পরিচালনায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখানো হয়নি। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সমস্ত সম্পদ, দায় ও দেনা কোম্পানির আওতায় এলে ট্রেন পরিচালনার আয় ও ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন তারা।
সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও ডিএমটিসিএল লোকসানে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ হিসেবে তারা প্রকল্পটির জন্য গৃহীত বিদেশী ঋণের প্রসঙ্গটি সামনে এনেছেন। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নেয়া হয়েছে, যা পরিশোধের দায়িত্ব ডিএমটিসিএলের। ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে। প্রকল্প ব্যয় থেকেই সেটি নির্বাহ করা হচ্ছে। ৩০ বছরে জাইকার এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সুদ ব্যতীত বার্ষিক গড় কিস্তির পরিমাণ প্রায় ৬৫৭ কোটি টাকা। ফলে লাভজনক পর্যায়ে যেতে হলে সংস্থাটিকে প্রতি বছর উত্তরা-মতিঝিল-কমলাপুর মেট্রো লাইন থেকে এর চেয়ে বেশি মুনাফা করতে হবে। মেট্রোরেল লাইন-৬-এর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শেষ হবে ২০৬১-৬২ অর্থবছরে গিয়ে।
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল বাণিজ্যিকভাবে চালু হয় ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। শুরুতে কয়েকটি স্টেশনে যাত্রাবিরতি দিয়ে মেট্রো ট্রেন চলাচল করত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আর একই বছরের ৩১ ডিসেম্বরে সবক’টি স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয়া শুরু করে।
ডিএমটিসিএলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চালুর পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে টিকিট বিক্রি বাবদ সংস্থাটির আয় হয় ১৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর গত ২০২৩-২৪ বছরে ডিএমটিসিএল আয় করে ২৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। প্রথম দুই অর্থবছরে সংস্থাটি ট্রেন পরিচালনা করে সব মিলিয়ে ২৬২ কোটি ১৯ লাখ টাকা আয় করে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে ডিমএমটিসিএলের পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৫২ কোটি ১৯ লাখ টাকা, যার সিংহভাগই গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে।
বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের পরও গত অর্থবছরে লোকসানে থাকার পেছনে প্রকল্প শেষ না হওয়াকে দায়ী করেছেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প এখনো চলমান। বর্তমানে একটা অন্তর্বর্তী অবস্থার মধ্যে রয়েছে। টিকিট বিক্রি থেকে কিছু আয় হচ্ছে, ব্যবসায়িক স্বচ্ছতার অংশ হিসেবে যা আমরা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। তবে এখনো আমরা (ডিএমটিসিএল) প্রকল্পের পুরো সম্পদ ও দায়দেনা পাইনি। ২০২৫ সালে যখন শেষ হবে তখন সম্পূর্ণ সম্পদ ও দায়দেনা কোম্পানির অধীনে আসবে। তখন আয়-ব্যয়, মুনাফা কোম্পানি আমলে নেবে। অ্যাসেট, লায়াবিলিটিজ, সরকারি ঋণ অনেক হিসাবনিকাশের ব্যাপার আছে। সব মিলেই বর্তমান ব্যালান্সশিট তৈরি করা হয়েছে।’
পরিচালন ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বিদ্যুৎ বিল প্রকল্প থেকে দিচ্ছি। যখন প্রকল্প শেষ হবে তখন কোম্পানি দেবে। বেতন ডিএমটিসিএল দিচ্ছে। ঋণ পরিশোধও প্রকল্প থেকে পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু যখন আমাদের কাছে চলে আসবে তখন কোম্পানি থেকে করতে হবে।’ আপাতত প্রকল্পের অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হলেও ভবিষ্যতে মেট্রোর আয় দিয়েই তা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এমআরটি লাইন-৬ ছাড়াও ডিএমটিসিএল বর্তমানে আরো চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ৫৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এমআরটি লাইন-১। এটি ঢাকার প্রথম পাতাল মেট্রোরেল। এ মেট্রোর দুটি রুট। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রুটটি পুরোটাই পাতালপথে। আর নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত রুটটি পাতাল ও উড়ালপথ মিলিয়ে তৈরি হবে। এর বাইরে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ডিএমটিসিএল। উড়াল ও পাতাল অংশ মিলিয়ে মেট্রোর এ রুট নির্মাণ করা হচ্ছে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারার মধ্যে। এমআরটি-১ ও এমআরটি-৫ নর্দান রুট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জাইকার ঋণে। এছাড়া এমআরটি লাইন-৫ সাউদার্ন রুট ও এমআরটি লাইন-১-এর জন্য আরো দুটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি।