আট দশকের রাজনীতিতে অধিকাংশ সময় শাসকদের শরিক ছিল জামায়াত

আট দশক আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ৮০ বছরের রাজনীতিতে অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতাসীনদের শরিক বা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে থেকেছে দলটি। উপমহাদেশে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ও ভারতে কার্যক্রম রয়েছে জামায়াতের। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে কখনো কখনো ‘কিং মেকারের’ তকমাও পেয়েছে দলটি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার

আট দশক আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ৮০ বছরের রাজনীতিতে অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতাসীনদের শরিক বা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে থেকেছে দলটি। উপমহাদেশে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ও ভারতে কার্যক্রম রয়েছে জামায়াতের। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে কখনো কখনো ‘কিং মেকারের’ তকমাও পেয়েছে দলটি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকারি পরিপত্র জারি করা হয়। 

শুধু বাংলাদেশ নয়; পাকিস্তানেও ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় রয়েছে দলটি। একই চিত্র দেখা যায় ভারতেও। এর মধ্যে কয়েকবার পড়তে হয়েছে নিষেধাজ্ঞার মুখে। তবে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনরা যেমন নিষিদ্ধ করেছে দলটিকে, আবার সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে দলটিকে কাজেও লাগিয়েছে। 

মওলানা আবুল আ’লা মওদুদীর হাত ধরে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম। লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে যাত্রা করে জামায়াত। পরের বছরেই লাহোর থেকে ভারতের পাঠানকোটে সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। শুরুর দিকে নিজেকে সামাজিক সংগঠন হিসেবে দাবি করত জামায়াত। ইসলামিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে সমাজের পরিবর্তনকে নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে দাবি করত দলটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক থেকে রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয় জামায়াত। বেশ শক্তিশালীভাবে যুক্ত হয় ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে। 

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জামায়াতের রাজপথে শক্তি রয়েছে। এটিই তাদের আকর্ষণের জায়গা। তারা যার সঙ্গে যায়, সে দলেরই রাজপথের শক্তি অনেক বেড়ে যায়। জনসমর্থন যা-ই থাকুক, রাজপথের শক্তির জন্যই জামায়াত এত আকর্ষণীয়। তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে খেলেছে। আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। বিএনপিও তাদেরকে নিয়ে সরকার গঠন করেছে। বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ করত আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে লুফে নিত।’ 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সোভিয়েত আমলে স্নায়ুযুদ্ধ জামায়াতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, যার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সে সময় তাদের নিজেদের কাছে রাখার চেষ্টা করেছে। ফলে শরিক দল হিসেবে কাজ করেছে দলটি। বাংলাদেশে এর শুরু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে হলেও এরশাদের আমলেই সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে জামায়াতে ইসলামী। একই কারণে পাকিস্তানেও জিয়াউল হকের শাসনামলেই ক্ষমতার সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে ছিল জামায়াত।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির আমলে পানিসম্পদ মন্ত্রী মেজর (অব.) মন্জুর কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সত্তরের দশকের শেষের দিকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিকাশ ঘটে জামায়াতে ইসলামীর। বাংলাদেশে জামায়াত আবার রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পায় জিয়াউর রহমানের সময়। এরশাদের শাসনামলেও সে ধারা অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সহায়তাও পায় দলটি। পাশাপাশি এরশাদ সাহেব নিজেও তখন রাশিয়া থেকে সরে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছেন। সব মিলিয়ে জামায়াত নিজেদের গড়ার জায়গা পেয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে কিংবা ক্ষমতায় থেকেছে। তবে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার কারণে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে প্রভাব পড়ে। ফলে বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ জামায়াতকে আর নিজেদের কাছে নেয়নি।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌পাকিস্তানের জিয়াউল হক যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেছিলেন। এরই অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে তারাও সুযোগ দিয়েছিল। পরে আস্তে আস্তে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির কারণে সেই জায়গা হারায় জামায়াতে ইসলামী।’

এক সময় পাকিস্তান সৃষ্টির বিপক্ষে আওয়াজ তুলেছিল জামায়াতে ইসলামী। সে সময় দলটিকে অনেকখানেই দেখা হতো ব্রিটিশের সমর্থক হিসেবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয় দলটি। দুই ভাগে বিভক্ত ছিল দলটি। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী হিন্দ—এ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল দলটি। 

পাকিস্তান আমলেও দুবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। প্রথমবার সেনাশাসক আইয়ুব খানের সময়, ১৯৫৮ সালে। ওই বছর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে অন্য সব দলের সঙ্গে জামায়াতের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ হয়। এর অর্ধদশক পরই আবারো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে দলটি। ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয়বার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও সে বছরই দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়। 

পাকিস্তানে ১৯৭৭ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন জিয়াউল হক। শুরু থেকেই জনসমর্থন আদায়ের জন্য জামায়াতের মতো দলগুলোর সহযোগিতা নিতে থাকেন তিনি। 

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনে প্রকাশিত এক নিবন্ধ অনুযায়ী, জিয়াউল হকের শাসনামলেই আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে ‘‌জিহাদে’ সমর্থন করেছিল জামায়াত। দলটি জিয়াউল হককে সমর্থন করেছিল, যিনি পাকিস্তানে মস্কোবিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ক্রমেই রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূর সরে যেতে থাকে জামায়াত। জেআই একটি ডানপন্থী জোটে (ইসলামী জামহুরি ইত্তেহাদ বা আইজেআই) যোগ দেয়, যা পিএমএল-এন সুপ্রিমো নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পিপিপির বিরোধিতা করার জন্য গঠিত হয়েছিল এ জোট। ১৯৯৩ সালের নির্বাচনের সময় আইজেআই দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এরপর নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ইসলামিক ফ্রন্ট (পিআইএফ) নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি একটি অংশ ১৯৫২ সালে পাকিস্তান অধ্যুষিত জম্মু-কাশ্মীরে যাত্রা করে। পঞ্চাশের দশকে কাশ্মীরে ছিল সুফিবাদের জয়জয়কার।’ 

ভারতের জম্মু-কাশ্মীর অংশে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে এ নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়। এতে করে পুনরায় নিজেদের পুনর্গঠনে কাজ করে দলটি। ২০০৮ সালের পর থেকে গত কয়েক বছর জম্মু-কাশ্মীর অংশে রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব জামায়াতে ইসলামীর ওপরও পড়েছে। যেখানে দলটি এখন স্বায়ত্তশাসনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সামাজিক কর্মকাণ্ডে। পাশাপাশি দলটির আদর্শিক জায়গায়ও প্রভাব পড়েছে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় দলটি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এরই সূত্র ধরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে সব ধরনের ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সংবিধানের ৩৮ ধারার ক্ষমতাবলে এ নিষেধাজ্ঞা আসে। আর এতে করে বন্ধ হয়ে যায় জামায়াতে ইসলামীর সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। 

স্বাধীন বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার বছর চারেক পর ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধানের (৩৮) ধারার উল্লেখিত অনুচ্ছেদগুলো বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়াই তাদের রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হতে বৈধতা প্রদান করে। যদিও পুরোপুরি দল গোছাতে আরো তিন বছর সময় লেগে যায়। 

এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতির ‘কিং মেকার’ জামায়াতে ইসলামী। এরশাদের শাসনামলেই এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় জামায়াত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের অধীনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০টি আসন পায় জামায়াত। তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জামায়াত। পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় দলটি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন করে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল জামায়াত। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জামায়াত তিনটি আসন পায়। ১৯৯৮ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট করে জামায়াত। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ১৭ আসন পেয়ে সরকারের শরিক হয়। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিতে শ্রেণীগতভাবে জামায়াত, বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি একই শ্রেণীভুক্ত। একেক সময় একেক দলের লেজ ধরে দলটি উদ্ভাসিত হতে চেয়েছিল। অনেক সময় তারা সফলও বটে। প্রথমে বিএনপি, এরপর জাতীয় পার্টি তারপর আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় বেশকিছু কাজ করেছিল। তাদের লোকজনকে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মেইনস্ট্রিমে যুক্ত করেছে। তারা আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কারণে সেটি গ্রহণ হয়নি। এমনকি সরকার যে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এতে আওয়ামী লীগের একটি অংশ সম্পূর্ণরূপে নাখোশ। তারা এজন্য নাখোশ যে, আজ যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, সেটি হতো না।

স্বাধীন বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞার ৫০ বছর পর আবারো নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অপরাধ প্রমাণিত। জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার দাবিটা ২০১৩ সালের আগে থেকেই রয়ে গেছে। এতদিন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেনি। এখন বিপদে পড়ে এটি করেছে। এমন একটা সময় এসে নিষিদ্ধ করেছে, যখন তাদের নিষিদ্ধ করা আর না করায় কিছু যায়-আসে না। এখন অন্য বিষয়গুলো নিয়ে গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে। এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা।’

আরও