স্বৈরশাসক জাইন এল আবিদিন বেন আলি তিউনিসিয়ার ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন ২৩ বছর। ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। আরব বসন্তের সূচনাকারী হিসেবে পরিচিত তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পায় জেসমিন রেভল্যুশন বা জেসমিন বিপ্লব নামে।
দেশটিতে অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরুতেই বিতর্কিত করে তোলে আগের প্রশাসনের সুবিধাভোগীদের উপস্থিতি। অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসন এবং আহতদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্তে ব্যর্থতা এ বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে তোলে। অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও তেমন কোনো অর্জন দেখাতে পারেনি দেশটির তৎকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। তৈরি করা যায়নি তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দ্রুত পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তেমন একটা সফলতা আসেনি। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সেক্যুলার ও উগ্র ডানপন্থীদের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বিস্তৃতি ঘটে ঘৃণা ও সংঘাতের। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে দেখা দেয় এক দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা। জেসমিন বিপ্লবের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে দেশটি।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট। পূর্ণ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের শততম দিন। এরই মধ্যে অভ্যুত্থানে আহতদের পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসা নিয়ে বিপত্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের দেখতে বুধবার রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে তোপের মুখে পড়ে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় তার পথ আটকে বিক্ষোভ করেন পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে থাকা আহতরা। পরে এ বিক্ষোভ থেকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি ওঠে। এরপর বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক বৈঠকে আহতদের পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার প্রতিশ্রুতির পর উত্তেজনার প্রশমন ঘটে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো সফলতা দেখা যায়নি এখনো। সর্বশেষ গত মাসেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হলেও ব্যাংক খাতে এখনো রয়ে গেছে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না বেশ কয়েকটি ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তারল্য সহায়তা পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির আওতায় আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা পেলেও এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকগুলো। বিনিয়োগ পরিস্থিতিতেও তেমন একটা উন্নতি দেখা যায়নি।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও দেখা যায়নি তেমন কোনো অগ্রগতি। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রূপরেখা নিয়ে এখনো কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে পারেনি দলগুলো। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে গোঁড়ামি ও বিদ্বেষপূর্ণ মতবাদ। জন ও মাঠ প্রশাসনেও এখনো বিগত আমলের আমলাদেরই আধিপত্য রয়ে গেছে।
বিনিয়োগ আকর্ষণসহ অর্থনীতির সংকট মোকাবেলায় নির্বাচিত সরকারই সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিতে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বরং দ্রব্যমূল্য আরো বাড়ছে। বিভিন্ন কারখানায় চাকরির ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল, সেখানেও খুব একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই। সামগ্রিকভাবে রাজনীতি বা অর্থনীতিতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং যত দেরি হচ্ছে অন্যান্য জায়গার মতো সংকটগুলো বাড়বে। নির্বাচিত সরকার হলে বিনিয়োগকারীসহ অন্যরা সরকারের ওপর আস্থা পাবে। সেটির জন্যই তারা অপেক্ষা করছে। এটি না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই।’
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে গত তিন মাসে তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি। উল্টো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংস অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। যদিও এখন খোদ সেনাবাহিনীর নাম ভাঙিয়েই চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
সর্বশেষ গতকালই এমন এক বিষয় নিয়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এতে বলা হয়েছে, ইদানীং কিছু অসাধু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে ঝুট ব্যবসার স্বত্ব প্রদান এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিচ্ছে, যা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিল্পাঞ্চলে শুধু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদনমুখী কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকল্পে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছে। ঝুট ব্যবসা বা অন্য কোনো ব্যবসার জন্য সুপারিশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর মনে করছেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু আমরা দেখছি এ দুটি বিষয়ে সরকার এখনো লক্ষণীয় কিছু করতে পারছে না। এ দুটি বিষয়ে কিছু করতে পারলে জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো সময় দেবে। কিন্তু না পারলে জনগণের মধ্যে অস্থিরতা বাড়বে, যা এ সরকারকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে। তাই এ দুটি বিষয়ে সরকারকে সফলতা দেখাতে হবে, যাতে জনগণ আশাবাদী হয় এবং মনে করে এ সরকার জনগণের চাহিদাগুলো পূরণ করছে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের উৎপাদনের সাপ্লাই চেইনে অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। এগুলোয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।’
তিউনিসিয়ায় অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রথম বিরোধ দৃশ্যমান হয় অন্তর্বর্তী সরকারে বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি নিয়ে। বাংলাদেশেও উপদেষ্টা পরিষদের বিভিন্ন সদস্যকে নিয়ে এমন বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক রয়েছে জন ও মাঠ প্রশাসন পুনর্গঠন নিয়েও। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১১৭ জন ‘বঞ্চিত’ সিনিয়র সহকারী সচিব পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। একইভাবে যুগ্ম সচিব হিসেবে ২০১ জন ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৩১ জন কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে, এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ প্রশাসনে নানা সুবিধা নিয়েছেন ও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। এ প্রশাসন পুনর্গঠনে পেছনের কারিগর হিসেবে দেখা হচ্ছে আলী ইমাম মজুমদারকে। ২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সে সময়ও সরকার পরিচালনায় প্রজাতন্ত্রের জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর মূল কারিগর ছিলেন তিনি। এ আমলা অবসরে যান ২০০৮ সালে। এরপর ১২ আগস্ট তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পান। পরে ১৬ আগস্ট তিনি ব্যক্তিগত সহকারীর পরিবর্তে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বর্তমানে তাকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদে এক-এগারোর অন্যতম কুশীলব হিসেবে পরিচিত কারো কারো উপস্থিতি নিয়েও নানা মহল থেকে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিতর্ককে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অন্তর্ভুক্তি। বিগত সরকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করে এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে উদ্বেগ ও আপত্তি জানানো হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থায় এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সবকিছু ভেঙে পড়েছিল। প্রতিষ্ঠান, নিয়ম-নীতি, দুর্নীতি সবকিছুতেই চরম নৈরাজ্যকর ও অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল সরকার। এগুলো থেকে উত্তরণ চাট্টিখানি কথা নয়। এমনকি এর জন্য আকাশ থেকে ফেরেশতা নেমে এলেও সংস্কার করা সহজ হতো না। তবুও এ সরকারে আরেকটু গতি আসা দরকার। কিছু প্রশ্ন উঠেছে, এ প্রশ্নগুলোর দিকে তাদের নজর দেয়া দরকার। অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে, যার মাধ্যমে পরিবর্তনের রূপরেখা তৈরি হবে। এগুলো পরে বাস্তবায়ন হবে। এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আশা করি এ সরকার সফল হবে।’
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও সংকট বেড়েছে। বিরোধ ও অবিশ্বাসের মাত্রা বেড়েছে গোঁড়া ডানপন্থী ও সেক্যুলারদের মধ্যে। উগ্রপন্থায় অভিযুক্তদের উত্থানও এখন দৃশ্যমান। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মব জাস্টিসের ঘটনাও।
বর্তমানের সংকটগুলোর জন্য শুধু এ সরকারকে দায়ী করা চলে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১০০ দিন একটি সরকারের জন্য খুব বেশি সময় নয়। এতগুলো সংস্কার করার জন্য এরই মধ্যে তারা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ চেয়ে চিঠি দিয়েছে। আমরাও আমাদের প্রস্তাবনাগুলো পাঠিয়েছি। রাজনৈতিক দলের বাইরেও বিভিন্ন খাতে বিশেষজ্ঞ এমনকি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও তারা বসছে। কোনো গ্রহণযোগ্য সরকারের যে প্রক্রিয়া, সেটি তারা শুরু করেছেন। একই সঙ্গে এ সরকারকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, এত রক্তের বিনিময়ে আমাদের অর্জন কেউ বাধাগ্রস্ত করবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অপশক্তিগুলো সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এ প্রতিবন্ধকতাগুলো না হলে হয়তো সংস্কারকাজ আরো খানিকটা এগিয়ে যেতে পারত। আবার বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসররাও এখনো নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যেহেতু নানা ধরনের ভিন্নমত নিয়ে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, আমরা যদি তাদেরকে সহযোগিতা করি; তাহলে একটু সময় লাগলেও নির্বাচনের জন্য মসৃণ যাত্রা শুরু হবে।’