দেশের স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদ্যমান উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) চূড়ান্ত খসড়া হাতে পেয়েছে পেট্রোবাংলা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে দিয়ে করা এ পিএসসি চূড়ান্ত করে দ্রুত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে যেতে চায় পেট্রোবাংলা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া খসড়ার ওপর এরই মধ্যে জ্বালানি বিভাগ গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বেশকিছু সংশোধন ও সুপারিশ দিয়েছে। এ সুপারিশ চূড়ান্ত করে জ্বালানি বিভাগে পাঠাবে পেট্রোবাংলা। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে। এরপর চূড়ান্ত দরপত্রে যাবে পেট্রোবাংলা।
অফশোরে (সাগরে) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোনো কোম্পানির সাড়া না পাওয়ায় গ্যাসের দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে স্থলভাগে (অনশোর) গ্যাস অনুসন্ধানের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এ কার্যক্রম শুরু হবে বলে মনে করছেন পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উড ম্যাকেঞ্জি পিএসসি হালনাগাদ করে একটা ড্রাফট পাঠিয়েছে। ওই রিপোর্টের ওপর একটি পেপার প্রেজেন্টেশন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের গঠিত ১৬ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি কিছু সংশোধন ও সুপারিশ দিয়েছে। সেই সঙ্গে পেট্রোবাংলার পিএসসি কমিটিও উড ম্যাকেঞ্জির রিপোর্ট নিয়ে একটি বৈঠক করেছে। তারা সেটি সংশোধন করে পাঠালে চূড়ান্ত করে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হবে। সেখান থেকে কোনো সুপারিশ থাকলে তা অন্তর্ভুক্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। এরপর ওই পিএসসি হালনাগাদের ওপর উন্মুক্ত মতামত নেবে মন্ত্রণালয়। এসব প্রয়োজনীয় কার্যক্রম করতে অন্তত দুই মাস সময় প্রয়োজন। সেই হিসাবে অনশোর পিএসসি চূড়ান্ত করতে আগামী জুন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।’
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার চেয়ে কম সময়ে স্থলভাগের অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব। দেশে গ্যাসের চাহিদা বিবেচনায় স্থলভাগই কম সময়ে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে দ্বিমাত্রিক জরিপের ভিত্তিতে উচ্চ সম্ভাবনাময়, মাঝারি সম্ভাবনাময় ও ন্যূনতম সম্ভাবনাময়—এ তিন ক্যাটাগরিতে ব্লকগুলো ভাগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে দেশীয় অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোর অংশ নেয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে অনশোর পিএসসিতে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর টেকনিক্যাল, ফাইন্যান্সিয়াল ও মানবসম্পদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে কাজ পাওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে।
দেশে ক্রমান্বয়ে স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের মোট উৎপাদন ১ হাজার ৮৫৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন একাই গ্যাস উত্তোলন করছে দৈনিক ১ হাজার ১৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। আর তিনটি দেশীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানির উৎপাদন দৈনিক গড়ে ৭২০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি।
স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে স্থলভাগে বড় আকারে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, অনশোর পিএসসি এমনভাবে করা হোক, যেখানে দেশী-বিদেশী সব কোম্পানি কাজ করতে আগ্রহী হয়। দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট। গ্রিডে দ্রুত গ্যাস প্রয়োজন। পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এককভাবে শুধু স্থানীয় কোম্পানি নয়, বিদেশী অনেক কোম্পানি বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে এমনকি ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্থলভাগে অনেক এলাকা অনাবিষ্কৃত। এসব এলাকায় গ্যাস পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। অনশোর পিএসসি আপডেট করে যদি বিদেশী কোম্পানি আনা যায় তাহলে দ্রুত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমাদের গ্যাসের সংকট প্রকট। পিএসসি এ রকম আকর্ষণীয় হওয়া প্রয়োজন, যেন ভালো কোম্পানি পাওয়া যায়। তবে লাভ-লোকসানের হিস্যাটাও ভালোভাবে হতে হবে। যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে।’
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দেশে গত বছরের মার্চে অফশোর পিএসসির আওতায় আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ দরপত্রের চূড়ান্ত সময়সীমা ছিল নয় মাস। সংশ্লিষ্ট সময়ে সাতটি কোম্পানি তেল-গ্যাসের নথি কিনলেও শেষ পর্যন্ত কোনো কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেয়নি। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেই সময় জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দেশের অফশোরে বিদেশী অনেক কোম্পানির আগ্রহ থাকলেও তারা দরপত্রে অংশ নেয়নি। তবে বহুজাতিক দুটি কোম্পানির সঙ্গে বণিক বার্তা যোগাযোগ করলে তারা জানায়, সাগরে দরপত্র আহ্বানে পেট্রোবাংলা যে পিএসসি তৈরি করেছে, সেখানে তেল-গ্যাসের দামে বৈশ্বিক কোম্পানিকে আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছু নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাগরে বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাস রয়েছে—এমন সম্ভাবনা পেট্রোবাংলার তথ্য-উপাত্তে পাওয়া যায়নি বলেও দাবি এসব বহুজাতিক কোম্পানির।
দেশের সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে বিদেশী কোম্পানির সাড়া না দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ। দরপত্র আহ্বানের আগে অনশোর পিএসসি হালনাগাদ করতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে যাচাই-বাছাই করে কীভাবে আরো আকর্ষণীয় করা যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্যাস পেলে তার হিস্যা এবং দামের বিষয়টি নিয়েও দফায় দফায় বৈঠক করবে পেট্রোবাংলা।
স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনশোরে গ্যাস অনুসন্ধানে প্রস্তুতি চলছে। তবে দ্রুত দরপত্র আহ্বান হচ্ছে না। কারণ এখানে গ্যাসের দরসহ নানা ইস্যু রয়েছে। সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই ও আলোচনা করা হবে। এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন স্টাডি মূল্যায়ন করে প্রস্তুতি নেয়া হবে। অফশোরের দরপত্রের মতো পুনরাবৃত্তি যেন না হয় তা পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে।’ অনশোরে এককভাবে কোনো কোম্পানিকে কাজ দেয়া হবে কিনা এমন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এককভাবে কাজ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দরপত্র আহ্বান করে যোগ্য কোম্পানি নির্বাচন করে কাজ দেয়া হবে।’
১৯৯৭ সালের পর স্থলভাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি আর হালনাগাদ করা হয়নি। এই পিএসসি হালনাগাদ করতে গত ২২ ডিসেম্বর উড ম্যাকেঞ্জিকে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই হিসাবে দীর্ঘ ২৭ বছর পর পর অনশোর পিএসসি হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্থলভাগে মোট ২২টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিতে এখনো কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। খালি থাকা ব্লকগুলো হচ্ছে ১, ২এ, ২বি, ৩এ, ৪এ, ৪বি, ৫, ৬এ, ২২এ, ২২বি ও ২৩ নম্বর। এসব ব্লকে কাজ করতে যোগ্যতম বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠন করে দরপত্রে অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরি করছে পেট্রোবাংলা। সেই সঙ্গে স্থলভাগের গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।