বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস প্রতিষ্ঠিত সাংহাইভিত্তিক বহুপক্ষীয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) আগামী এক বছরে বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ডলার তহবিল সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে এনডিবি বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।’
গতকাল বিকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ জানান, তিনি গতকাল ব্রিকসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির কাজবেকভ ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তারা (ব্রিকস) বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক ধারণা প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি ওয়াসার সঙ্গে তারা একটি প্রকল্প শুরু করেছে। তারা শুধু সরকারি খাত নয়, বেসরকারি খাতেও অর্থায়ন করতে চায়। আমরাও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে হাসপাতাল, হাউজিংসহ সামাজিক অবকাঠামোতেও তাদের তহবিল সরবরাহ করার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীরা এসেছেন। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন। ৩০ জনের একটি কোরিয়ান দল এসেছে। তারা কোরিয়ান ইপিজেড ঘুরে দেখেছেন। কিছু জায়গায় সমস্যার কথা তারা বলেছেন। আমরা সমাধান করেছি। তারাও খুশি হয়েছেন। একই চিত্র জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রেও। জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যারা এ মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে উৎপাদন শুরু করতে চান তাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারণ এখানে সবকিছু প্রস্তুত। যেসব বিনিয়োগকারী এ জায়গা পরিদর্শনে গিয়েছেন তারা দেখে খুব খুশি হয়েছেন।’
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘আমেরিকা থেকে একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল এসেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আজ জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক বিনিয়োগকারী আগে বাংলাদেশে আসেননি। কিন্তু এবার এসেছেন। তাদের অনেকের বাংলাদেশ নিয়ে বিরূপ ধারণা ছিল। কিন্তু সবকিছু পরিদর্শনের পর তাদের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা দেখে গিয়েছে। এসব ধারণা তাদের দেশে ফিরে একই সিস্টেমের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের বললে তারাও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। এছাড়া চাইনিজ বড় বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানিও বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।’
চৌধুরী আশিক মাহমুদ আরো জানান, বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে ‘আর্টেমিস চুক্তি’ সই করেছে বাংলাদেশ। গতকাল তার ও ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের উপস্থিতিতে প্রতিরক্ষা সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন এ চুক্তিতে সই করেন। এ উদ্যোগের মাধ্যমে বৈশ্বিক মহাকাশ গবেষণা, মহাকাশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও মহাকাশসম্পদের দায়িত্বশীল ব্যবহারে যুক্ত হলো বাংলাদেশ।
এ নিয়ে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘চুক্তিটি সইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মহাকাশ গবেষণায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মহাকাশ গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে। আমাদের দেশের তরুণ ও যুবকরা মহাবিশ্ব নিয়ে নতুন ধারণা পাবে।’
নারায়ণগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের চার দিনব্যাপী বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড) বা জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন সফররত বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। গতকাল সকালে বিডার ব্যবস্থাপনায় চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ৩৬ জন বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সেখানে যান। শুরুতেই তাদের সামনে বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ।
বিনিয়োগকারীরা পরিদর্শনের সময় সেখানে বিনিয়োগ পরিবেশ, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো বিষয়ে খোঁজখবর নেন। সুযোগ-সুবিধা ও কর্মপরিবেশ খতিয়ে দেখেন। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে মতামত তুলে ধরেন তারা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ক–কর, গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো পরিষেবা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলো যেন রক্ষা করা হয় এমন তাগিদ দিয়েছেন তারা।
পরিদর্শনে যাওয়া ৩৬ বিনিয়োগকারীর মধ্যে চীনের ১০ জন, জাপানের তিন, সৌদি আরবের তিন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের তিন, যুক্তরাষ্ট্রের আট ও ভারতের একজন ছিলেন। এছাড়া আটজন অনাবাসী বাংলাদেশী (এনআরবি) ছিলেন। প্রতিনিধি দলটি বিএসইজেডে অবস্থিত সিঙ্গারের কারখানা ঘুরে দেখে। সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএইচএম ফাইরোজ এ সময় তাদের ঘুরিয়ে দেখান।
বিএসইজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারো কাওয়াচি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে কী ধরনের আধুনিক কারখানা স্থাপন করা সম্ভব, তার ভালো উদাহরণ হতে পারে এই সিঙ্গারের কারখানা। মাত্র ২০ মাস সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করেছে সিঙ্গার। তারা বিনিয়োগ করেছে ৭৮ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে এ কারখানায় প্রতি মাসে ৫০ হাজার ইউনিট ফ্রিজ ও ১০ হাজার ইউনিট টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বৈশ্বিক মানের উন্নত পরিষেবা আছে এখানে। পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির সুবিধার্থে অর্থনৈতিক অঞ্চলেই বন্ডেড ট্রান্সপোর্টের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ফলে বন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন হয় না। এখানে যারা বিনিয়োগ করবেন, তাদের কোনো অসুবিধার মুখে পড়তে হবে না।’
এদিকে সকালে নিলর্ন বাংলাদেশ নামে সুইডেনের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটি তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করে। নিলর্ন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল কাইয়ুম জানান, বাংলাদেশে তাদের একটি কারখানা আছে। এখন তারা এসইজেডে আরো বড় পরিসরে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। তারা ধাপে ধাপে ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ‘সোমবার ও আজ (মঙ্গলবার) বিনিয়োগকারীরা দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পরিদর্শনের পর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অতীতে যেসব বাধা বা চ্যালেঞ্জ ছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তা দূর করার জন্য কাজ করছে। বিশেষ করে ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। এখানে নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা ও সুশাসনের অভাব ছিল, যে কারণে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতো। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।’