দেশের ব্যাংকগুলো থেকে গত দেড় দশকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই এখন আর ফেরত আসছে না। এর প্রভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। গত ডিসেম্বরেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হিসেবে স্বীকৃত খাতটির ৩০ শতাংশেরও বেশি ঋণ এরই মধ্যে খেলাপির খাতায় উঠে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পরই দেশের ব্যাংক খাতের ক্ষত ফুটে উঠতে শুরু করে। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার দেখানো হয়েছে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। জুনে সেটি ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশে ঠেকে। আর ডিসেম্বরে এসে খেলাপি ঋণের এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের আশপাশে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দেশের ব্যাংকগুলোয় এখন ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা দলও ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো থেকে খেলাপি ঋণের যে তথ্য পাওয়া গেছে, সেটি ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। তবে বেসরকারি খাতের যে ১২টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে, সেগুলোয় এখন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়েও অডিট করা হচ্ছে। সেসব অডিট শেষ হলে খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বণিক বার্তাকে জানান, ‘প্রতি ত্রৈমাসিকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হয়। গত ডিসেম্বরের খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করার সম্ভাবনা রয়েছে।’
খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘অতীতে গোপন করা খেলাপি ঋণ এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ হার ৪০ শতাংশে ঠেকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা মনে করি, ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত করা সম্ভব হলে সংকট থেকে উত্তরণের পথও সহজ হবে।’
দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে বলে এর আগে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গভর্নর পদে যোগদানের পর তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে গত ১৫ বছর যে পরিমাণ অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হয়েছে, সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিশ্বের কোথাও একসঙ্গে এত ব্যাংক লুট হয়নি। এস আলম, বেক্সিমকোসহ কিছু গ্রুপ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।’
খেলাপি ঋণের হার যে ৩০ শতাংশ ছাড়াবে, সেটির আভাস দেয়া হয়েছে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতেও। ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হলো খেলাপি ঋণ। এ খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণগত ঘাটতি ও অর্থ পাচারের মতো অপরাধ তথা শোষণমূলক অনুশীলন বড় ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাত থেকে এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপসহ শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কয়েকজন ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছে। এ ঋণ এখন আর ফেরত আসছে না। এসব ঋণের পুরোটাই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামীতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার কমিয়ে আনা খুবই কঠিন হবে।’
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্তও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের মাস তথা গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় ঠেকে। এ ঋণের বাইরেও প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়। আর খেলাপি কম দেখাতে গত কয়েক বছরে বাছবিচার ছাড়াই লাখ লাখ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশ তথা ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ আগে থেকেই ‘দুর্দশাগ্রস্ত’।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, গভর্নর নিজেই বলেছেন খেলাপি ঋণ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে খেলাপি ঋণের হার এর চেয়েও বেশি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে ১২টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে, সেগুলোয় এখন নিরীক্ষা চলছে। ওই ব্যাংকগুলোর কত শতাংশ ঋণ নিয়মিত থাকবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
কোনো দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে সে দেশের কান্ট্রি রেটিং বা সার্বভৌম ঋণমান কমে যায়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ঋণমান নেতিবাচক। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের হার আরো বেড়ে যাওয়ায় বিদেশীদের কাছে কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিদেশী ব্যাংকগুলো অনেক আগেই আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট লিমিট বা ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বলছি, তোমরা একটু ধৈর্য ধরো। আমাদের ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি দেখো। কারণ ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধ করবে তারল্য দিয়ে। সেক্ষেত্রে আপাতত খেলাপি ঋণের হার দেখার দরকার নেই। বিশ্বের অনেক দেশই এর আগে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতিতে পড়েছে। সে পরিস্থিতি থেকে তারা উত্তরণও ঘটিয়েছে। আমি মনে করি, অপরাধ-লুণ্ঠন যা হওয়ার হয়েছে। এখন আর নতুন করে যাতে অপরাধ না হয়, সেটি লক্ষ রাখতে হবে। ব্যাংক খাতে অবশ্যই শতভাগ গভর্ন্যান্স নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আর ঘুরে দাঁড়ানো যাবে না।’
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বিদেশী ব্যাংকগুলোও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ঋণ দিতেও ভয় পাচ্ছি। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ভালো ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আগামীতে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতকে ঘুরে দাঁড় করাতে হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগে ঠিক করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে গণ-অভ্যুত্থানের সুফল থেকে জনগণ বঞ্চিত হবে।’