আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি, লুণ্ঠন বন্ধ এবং বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলের দাবি ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুর্নীতি ও আর্থিক চাপ কমাতে শুরুতেই এ খাতের বিশেষ আইন স্থগিত এবং পরে বাতিল করা হয়। পাশাপাশি বিদ্যুতের ক্রয়চুক্তি পর্যালোচনা, ট্যারিফ সংশোধনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আট মাস পেরিয়ে গেলেও এ উদ্যোগে বিদ্যুতের সামগ্রিক ব্যয় যেমন কমেনি, তেমনি ভোক্তার বিদ্যুৎ খরচও কমানো যায়নি। এমনকি বিদ্যুতের কোনো ক্রয়চুক্তিও বাতিল করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
বিদ্যুৎ খাতে পাকিস্তান সরকারের মতো ভোক্তামুখী পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে এ খাতের ব্যয় কমানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা দাবি করেন, সরকারের বিদ্যুৎ খাতে নেয়া পদক্ষেপগুলো জনকল্যাণমুখী নয়। একই সঙ্গে তাদের সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পুরনো ও আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বিদ্যুৎ খাতের মডেল অব্যাহত থাকায় এ খাতের স্থিতিশীলতা আনতে ভর্তুকিকে সমাধান বিবেচনা করা হচ্ছে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক চাপ ও ব্যয় না কমার অন্যতম কারণ বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ বকেয়া। একই সঙ্গে চুক্তি বাতিলের আইনগত জটিলতা।
বিদ্যুৎ খাত সংস্কারে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও এখনো এ খাতের দৃশ্যমান কোনো আর্থিক সুফল পাওয়া যায়নি। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের বাজেটে দেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি চলমান সংশোধিত বাজেটে আরো ২২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত) বিশেষ আইনে হওয়া চুক্তি পর্যালোচনা করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতেই জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে সরকার। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের অধীনে করা এসব চুক্তিতে সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো রক্ষিত হয়েছে কিনা তা নিরীক্ষা করা এবং সরকারকে সুপারিশ দিতে বলা হয়। গত ২৪ নভেম্বর এ কমিটি সরকারকে আন্তর্জাতিক আইনি ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দেয়। এ কমিটি আদানি, সামিট, বেক্সিমকো, ইন্ট্রাকোসহ ১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করেছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা সেটি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির এক সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখা হয়েছে। সেখানে মোটা দাগে দুর্নীতির তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তবে অধিকতর তদন্তে বিদেশী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে আরো খতিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে।’ তবে এর বেশি এ কর্মকর্তা আর কিছু বলতে চাননি।
জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনো আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। ফলে এসব বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি তদন্ত ও অনুসন্ধানে ঢিলেমি তৈরি হয়েছে। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার কার্যক্রম ও আর্থিক চাপ কমাতে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দরকার। শুরুতে গতি থাকলেও এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না।
দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনা দরপত্রে কাজ পেয়েছিল ভারতীয় কোম্পানি আদানি পাওয়ার। এ কোম্পানিকে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়। গোপনীয় এ চুক্তিতে আদানিকে বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার কারণে চুক্তিটি বাতিলের আহ্বান জানায় বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন। কিন্তু কোনো চুক্তিই এখন পর্যন্ত বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় কমাতে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করেছিল সরকার। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ছয় সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। আড়াই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও এ কমিটি থেকে এখনো কোনো সুপারিশ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) শীর্ষ নির্বাহীরা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখনো কমিটির (ট্যারিফ পর্যালোচনা কমিটি) কাছ থেকে কোনো সুপারিশ হাতে আসেনি।’
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আওয়ামী লীগের সময়ে পাওয়া দরপত্রহীন সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিন ডজনের বেশি প্রকল্পের এলওআই (লেটার অব ইনটেন্ট) বাতিল করে বর্তমান সরকার। কিন্তু এসব প্রকল্প বাতিল করে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরিতে দরপত্র আহ্বান করা হলেও সেই কাজে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং বিনা দরপত্রে কাজ দেয়া হয় আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে। এতে বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন দেশী-বিদেশী কোম্পানি বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে যায়। বিদ্যুতের অব্যাহত এ লোকসান কাটাতে বছরের পর বছর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যায় আওয়ামী লীগ সরকার। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তেমনি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়েছে ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রায় চুক্তি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দীর্ঘ সময় এককভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপিডিবি। ট্যারিফ চুক্তি সংশোধনে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে মতামত দিয়ে আসছিলেন স্থানীয় মুদ্রায় বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করতে। কিন্তু সেটি এখনো করা যায়নি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও সরকারের নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় ও আর্থিক চাপ কমাতে হলে জোরালো কিছু উদ্যোগ দরকার ছিল। দেশের স্বার্থ বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ খাতের দুর্নীতি, অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখার বড় সুযোগ ছিল। যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি বাতিল, কেন্দ্রগুলোর কাঠামোগত সংস্কার, সরকারের দিক থেকে বিদ্যুৎ খাতে সুযোগ-সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটি করা যায়নি। বরং আগের সরকারের করা এ খাতের সব চুক্তির দায়মুক্তি দিয়ে দুর্নীতিকে ধাপাচাপা দেয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাকিস্তানের বিদ্যুৎ খাতে খরচ কমানোর বড় উদ্যোগটি হলো ট্যারিফ পর্যালোচনা করা। নতুবা বিদ্যুৎ কেন্দ্র অডিট করা। সেখানকার বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তারা সরকারের ট্যারিফ পর্যালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছে। যে কারণে ট্যারিফে ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে তারা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় কমাতে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা করা যায়নি। এখানে বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার কার্যক্রমে দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ দরকার। যারা বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখে-বুঝে সরকারকে সুপারিশ দেবে। কিন্তু দেশে এ ধরনের বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে পর্যালোচনা কমিটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ করেছে।’
জানা যায়, দেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছে টাকার অবমূল্যায়ন। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ডলারের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ ঘটনা বিদ্যুতের ট্যারিফেও প্রভাব ফেলেছে। বিপিডিবি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালে বিদ্যুতের গড় মূল্য কিলোওয়াটপ্রতি যেখানে সাড়ে ৬ টাকা ছিল, সেখানে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ তা সাড়ে ১০ টাকায় দাঁড়ায়।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের ক্রয়চুক্তি পর্যালোচনা, ট্যারিফ পর্যালোচনাসহ বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারে বেশ কয়েকটি কমিটি কাজ করছে। তবে এসব কমিটির তৎপরতা ও সদিচ্ছা এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার ও ব্যয় কমানো পুরোপুরি সরকারের সদিচ্ছা ও জোরালো প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল। সংস্কার করলেই বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় কমে আসবে, তার বড় উদাহরণ পাকিস্তান। কারণ তারা এরই মধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক হারে ব্যয় কমিয়ে এনেছে। অথচ তাদের সমস্যাগুলো আমাদেরও প্রধান সমস্যা। কিন্তু আমরা সেটা কেন পারছি না। সরকার সংস্কারের জোরালো পদক্ষেপ নিলেই কেবল এ খাতের খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য সরকারকে জনগণের কথা মাথায় রেখে উদ্যোগ নিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক মনোভাবে কিংবা পদ্ধতি দিয়ে তা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ খাতে অপচয়, চুরি, লুণ্ঠনমূলক ব্যয় কমানো গেলে ভর্তুকি বাড়ানো নয়, বরং কমিয়ে দেয়া শতভাগ সম্ভব।’
বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের ব্যয় কমাতে সার্ভিস চার্জ ৯ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশে আনা হয়েছে। বিদ্যুতের অযৌক্তিক ব্যয় কমাতে অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অবসরের পরিকল্পনা রয়েছে। বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বেশ কিছুদিন আগে বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘বিদ্যুতে খরচ কীভাবে কমানো যায় সেই লক্ষ্যে পিডিবি কাজ করছে। সেখানে অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবসরে দেয়ার মতো পরিকল্পনা রয়েছে, ট্যারিফ পর্যালোচনা এবং ক্রয়চুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন কমিটি কাজ করছে। আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছি।’
বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের মন্তব্য জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ প্রতিবেদন তৈরি হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।