বাংলাদেশে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) ও এর অধীন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো (পবিস) গ্রামাঞ্চলে শতভাগ বিদ্যুতায়নে সফল হিসেবে স্বীকৃত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে এ বিদ্যুৎ সেবার আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিআরইবির দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে গত সাড়ে চার দশকে বড় ভূমিকা রেখেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো। আবার সময়ের পরিক্রমায় এসব সমিতি বিআরইবির সঙ্গে দ্বন্দ্বেও জড়িয়েছে। এ দ্বন্দ্ব এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অতিসত্বর এর যৌক্তিক সমাধান না হলে ভবিষ্যতে গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখাসহ গোটা বিদ্যুৎ খাতেই বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
তারা বলছেন, বিআরইবি-পল্লী বিদ্যুতের মধ্যকার এ দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। দ্রুত সমাধান না হলে উভয় পক্ষের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের সফল মডেলটিকেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার বড় আশঙ্কা রয়েছে।
বিআরইবির বিরুদ্ধে কেনাকাটাসহ নানা কার্যক্রমে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে আসছে সমিতিগুলো। বর্তমানে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে বিআরইবির সঙ্গে একীভূতকরণের দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণেরও দাবি তোলা হচ্ছে। বিআরইবি ও পবিসগুলোর মধ্যে চলমান এ সংকট সমাধানে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিআরইবি ও সমিতির ভূমিকা এবং কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের। এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটিসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পবিসগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বিআরইবির আওতাধীন হয়ে কাজ করছে। তারা দেশের বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ কমিটিকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ভূমিকা ও কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। এতে সময়ের প্রয়োজন। যৌক্তিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। এখনই এ বিষয়ে বিস্তৃত কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’
দেশে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতায়ন শুরু হয়েছিল মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরইসিএ) সহযোগিতায়। ১৯৭৬ সালে সংস্থাটি বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষার প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে পরের বছর স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ১৯৮০ সালের মধ্যে গড়ে তোলা হয় ১৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পবিস)। এজন্য কারিগরি সহায়তা দেয় এনআরইসিএ। আর্থিক সহায়তা দেয় ইউএসএআইডি। তখন থেকে এ পর্যন্ত দেশের পল্লী এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার দেশ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র। পবিসগুলো গড়ে তোলার পাশাপাশি বিআরইবির কার্যক্রমও পরিচালিত হয়েছে মূলত এনআরইসিএর মডেলে।
এ মডেল অনুসরণ করে দেশের পল্লী এলাকায় এখন শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘটেছে। বর্তমানে বিআরইবির আওতাধীন দেশে ৬১ জেলার ৪৬২ উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে। ৮০টি পবিসের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় ৮৫ হাজার ৩৬৮ গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
বিশাল এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সমিতির জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য, কেনাকাটা এমনকি বদলি ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একক এখতিয়ার শুধু বিআরইবির। এক্ষেত্রে মিটার বসানো থেকে শুরু করে সঞ্চালন লাইনের যাবতীয় কেনাকাটায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিআরইবির। আর এ নিয়ে এখন আপত্তি তুলছে সমিতিগুলো। উভয় পক্ষের মধ্যে চলমান এ সংকটে এখন সমিতি ও বোর্ড একীভূতকরণ এবং সমিতির বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্থায়ী কর্মসংস্থানের বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছে। আর এসব নিয়ে চাকরিচ্যুতি, বহিষ্কার, মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনায় সমিতিগুলোয় এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিআরইবির ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বিআরইবির কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে ১ হাজার ৪৪৭ জন সদস্য। অন্যদিকে পবিসের আওতাধীন সদস্য রয়েছে ৩০ হাজার ৩৫৭ জন। যদিও পবিসগুলোর দাবি, সমিতিগুলোয় অন্তত ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাদের বড় একটি অংশ অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত।
বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারণ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিপুলসংখ্যক অস্থায়ী কর্মীর চাকরি স্থায়ীকরণে বড় বাধা অর্থের সংকট। আর একীভূতকরণের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সমিতিগুলোর কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ। এছাড়া বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বলেও এ সময় মন্তব্য করেছেন তিনি।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর সংকটের অন্যতম একটি কারণ আর্থিক দৈন্যতা। সমিতিগুলো বছরের পর বছর লোকসানে থাকলেও কখনো তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং লোকসানি সমিতিগুলোকে সুদ দিয়ে বছরের পর বছর মুনাফা করছে বিআরইবি। বর্তমানে ৮০টি পবিসের মধ্যে মুনাফায় আছে ১২টি। আর ব্রেক ইভেনে আছে মাত্র একটি। ৬৭টি পবিস লোকসানে থাকায় ক্রস সাবসিডি থেকে সুদ আদায় করছে আরইবি। এতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি না পেয়ে লোকসানে থাকা পবিসগুলো আর্থিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিআরইবির ৮০টি সমিতির মধ্যে ১৩টি লাভজনক অবস্থানে রয়েছে। বাকিগুলো লোকসানে। সবগুলো সমিতিকে লাভজনক করতে প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পবিসগুলোর দাবি তাৎক্ষণিকভাবে পালন না করা গেলেও এর যৌক্তিক সমাধান প্রয়োজন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিআরইবি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ পর্যায়ে বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা। এখন শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়ে গেছে। বিআরইবিকে এখন অন্য ধারায় কাজ করতে হবে।’