গ্রেফতার হন কারাবরণ করেন, রাজনীতিতে টিকে থাকেন এরশাদ

১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর। আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি মেনে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পদত্যাগ করেন ৬ ডিসেম্বর।

১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর। আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি মেনে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পদত্যাগ করেন ৬ ডিসেম্বর। ক্ষমতা ছাড়ার পর পরই কারাবরণ করতে হয় দীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতায় থাকা প্রতাপশালী এ নেতাকে। নানা মামলায় টানা পাঁচ বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ সময় তার নামে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালু রাখে তার দল জাতীয় পার্টি। জেলে থাকা অবস্থায়ই ১৯৯০ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। দুবারই পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একপর্যায়ে বাংলাদেশে বড় দুই দলের ক্ষমতার দ্বৈরথে প্রভাবকও হয়ে ওঠেন তিনি। নির্বাচনী রাজনীতিতে কিংমেকারের তকমা পায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি।

রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, আইন মেনে কারাবরণ করেই রাজনীতিতে নিজের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাশাপাশি নিজের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে। একপর্যায়ে রাজনীতিতে কিংমেকারও হয়ে ওঠেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাই এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্ষমতা ছাড়ার পর বিশেষ আইনে গ্রেফতার করা হয় প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। জনতা টাওয়ারের মামলা ও প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তবে বেশির ভাগ মামলা ও মামলার রায় সঠিক ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি পাঁচ বছর জেলে বন্দি ছিলেন। জনগণের চোখে তিনি সবসময়ই নির্দোষ ছিলেন। এভাবে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে বন্দি রাখায় তার প্রতি মানুষের খারাপ লাগা বাড়ে, যা তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া রাজনীতিতে এরশাদ সাহেবের টিকে থাকার অন্যতম কারণ হলো তিনি একই সঙ্গে সংস্কার ও উন্নয়ন করেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের তার প্রতি সমর্থন ছিল। এ সমর্থনের জন্য জেলে থাকা অবস্থায়ই তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এরশাদের পতনকে অনেকেই গণ-অভ্যুত্থান বলে। কিন্তু এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন। গণ-অভ্যুত্থানের পর তো কেউ রাজনীতিতে ফেরত আসতে পারে না। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে ফেরত আসতে পেরেছেন। এরশাদ সাহেব চাইতেন, জনগণ যেভাবে চাইবে তিনি সেভাবেই কাজ করবেন। তাই আন্দোলনের একপর্যায়ে নিজে থেকেই ক্ষমতা ছেড়ে দেন।’

ক্ষমতা গ্রহণের সময় এরশাদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিল জাসদ ছাত্রলীগ। তখন থেকে এরশাদের ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনগুলোই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে শুরুর দিকে সবচেয়ে বড় আন্দোলন ছিল শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির এ আন্দোলনে জয়নাল, জাফর, দীপালি সাহাসহ অন্তত ১০ শিক্ষার্থী শহীদ হন। এ ঘটনা পরে এরশাদবিরোধী আন্দোলনগুলো গড়ে তোলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক নথিতে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতায় আসার পরই এরশাদ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মধ্যপন্থী ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করেন তিনি। ভারতের প্রতি সন্দিহান থাকলেও প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখায় গুরুত্ব দেয় জাতীয় পার্টি। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও মানবিক সহযোগিতার সম্পর্কটি বেশ গভীরে যায় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। তৎকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এরশাদও সেটি বজায় রাখেন। পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে থাকা সত্ত্বেও পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে মস্কোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় বাংলাদেশ চীন থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করলেও মিগ-২১ যুদ্ধবিমান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর। আর্থিক সহযোগিতার জন্য মুসলিম বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এজন্য ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমেই বিদেশ সফর হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নেন তিনি।

একই সময়ে দেশে তার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছিল। এর সূত্রপাত ঘটে বিরাশির শিক্ষা আন্দোলনের সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে, যা পরে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আরো জোরালো হতে থাকে। নব্বইয়ের অক্টোবরে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমেই গতিশীল হয়ে ওঠে। নভেম্বরে তা তীব্রতা পায়। সারা দেশ অচলাবস্থায় চলে যায়। প্রায় ২৪টি ছাত্রসংগঠন একত্রে সে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে অনেক শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। অনেকেই কর্মবিরতিতে চলে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ৩ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শান্তি আলোচনা করতে রাজি হন। কিন্তু এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে পরের দিন প্রায় এক লাখ লোক ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। সেদিনই পদত্যাগের ঘোষণা দেন এরশাদ। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পদত্যাগ করেন তিনি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। নাগরিক ঐক্যের এ আহ্বায়ক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা ছাত্ররাই গড়ে তুলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় হামলা করে ছাত্র হত্যা করা, মরদেহ গুম করার মতো বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছিলেন এরশাদ। আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৮২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ভবন ঘেরাও করতে গিয়েছিল শিক্ষার্থীরা; সেখানেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে সেদিন। অর্থাৎ বীভৎস এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তৎকালীন শিক্ষার্থীরা তখন সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোও আন্দোলনে যুক্ত হয়। একপর্যায়ে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এমন আচরণ করে যে তাদের আকাঙ্ক্ষা ফানুসের মতো উড়ে যায়। এরশাদ সাহেবের পতনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ও উন্নত সমাজ গঠনের জন্য তিন দলের জোটরেখা হয়েছিল। কিন্তু পরে দুই দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াইয়ের কারণেই এরশাদ ফিরে আসতে পারেন। এছাড়া তিনি লাগাতার পাঁচ বছর জেল খেটেছিলেন। সত্যি বলতে, তিনি মানুষের ওপর নির্যাতন করলেও তার দু-একটি কর্মসূচি মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। যেমন উপজেলা গঠন ও ওষুধ নীতি। এছাড়া এরশাদ সাহেব বিরোধী দলের নেতাদের গালমন্দ করতেন না।’

রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ১৯৯০ সালে এইচএম এরশাদের পতনের পর পরই তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় কারাবরণ করতে হয় তাকে। পরে সে তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। সব মিলিয়ে সাবেক এ রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল ৪৩টি। ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দেয়া হতো মূলত তার সঙ্গে দরকষাকষির জন্য। যখনই এরশাদ ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যেতেন, তখনই পুরনো মামলাগুলো সক্রিয় করা হতো। এছাড়া বিভিন্ন সময় তার দল জাতীয় পার্টিকে বিভাজনের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে সাবেক সরকারি দল। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের সময় আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মহাজোটে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। আমৃত্যু ক্ষমতার সঙ্গে ছিলেন এরশাদ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূতও ছিলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পাটির সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী মনজুর কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরশাদ সাহেব ছিলেন বেনাভোলেন্ট ডিক্টেটর। ক্ষমতা গ্রহণের পরই এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ক্ষমতায় থাকাকালীন পুরোটা সময় জুড়ে বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ এবং বেশকিছু হত্যার ঘটনা ঘটে। তবে শেষের দিকে যখন গণ-অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি হয় এবং হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ বাড়তে থাকে তখনই তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিশেষ করে ডা. মিলন হত্যার পর। তবে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার সময় এরশাদের বিরুদ্ধে আইনের বাইরে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে না বলে তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনিও আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা রেখেই ক্ষমতা ছেড়ে দেন। যদিও এরশাদকে শুরুতেই জেলে নেয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা ভঙ্গ করা হয়। পরে এরশাদ জেলে যান। সেখানে টানা পাঁচ বছর কাটান তিনি, যা তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোয় সহযোগিতা করে। জেলে থেকেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এরশাদ নিজেই পাঁচটি আসনে জয়ী হন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এরশাদ সাহেব গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করেন। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা ছিল জনপ্রিয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল। বিচার বিভাগ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। ক্ষমতা চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তার নিজস্ব কোনো ছাত্রসংগঠন ছিল না। এগুলো তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সহযোগিতা করে।’

আরও