ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গত সেপ্টেম্বরে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে। ঘটনাটি নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনা হয়। পরে জানা যায়, তোফাজ্জল চোর নন, শুধু সন্দেহ থেকেই তাকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর মামলা হয়। পরে ২১ শিক্ষার্থীর নামে চার্জশিট দেয় পুলিশ। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, তোফাজ্জলের ঘটনাটি বেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছিল বিধায় আসামিরা গ্রেফতার হয়। তবে এ ধরনের ঘটনায় বেশির ভাগ সময় আসামিরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পিটিয়ে হত্যার প্রবণতা নিয়ে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ও মানবাধিকার কর্মী টিপু সুলতান বলেন, ‘এগুলোও এক ধরনের বিচার-বহির্ভূত হত্যা। কিন্তু এসব ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে যেখানে আসামিরা থাকে অজ্ঞাত। যথাযথভাবে মামলা হচ্ছে না। যারা ঘটাচ্ছে, তাদের ধরা হচ্ছে না। কিন্তু ধরা উচিত। এসব ঘটনা ঠিকঠাক বিচারও হয় না। ফলে এ অপরাধ বারবার সংঘটিত হচ্ছে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবরে ২৭টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হন আটজন। এসব ঘটনায় মাত্র সাতটি মামলা হয়েছে বলে সে সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করে কমিশন। তবে অক্টোবরের পর কতজন হত্যার শিকার হয়েছেন বা এসব ঘটনায় মামলার বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করেও সংস্থাটির কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যমতে, ২০২৪ সালে কমপক্ষে ১৬৯টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৪৬ জন মারা গেছেন। এছাড়া ১২৬ জন মারাত্মক আহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় পুলিশে দেয়া হয়েছে ৪৭ জনকে। আক্রান্তদের মধ্যে পাঁচজন নারী ও তিনজন কিশোর রয়েছেন।
সংস্থাটির তথ্য বলছে, বিভিন্ন সময় চুরির সন্দেহে ৫৮ জন, ডাকাতির সন্দেহে ১৩, চুরি, ছিনতাই এবং চাঁদাবাজির সন্দেহে ১৬, গণধর্ষণের সন্দেহে ৫, খুনের মামলায় ৬, সন্দেহজনক চলাচলের অজুহাতে ৪, অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে ৬, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ৫, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ৬, মাদক পাচার, চোরাচালান, অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে ৬ এবং জমিসংক্রান্ত বিরোধ, মৌখিক বিরোধ, মানসিক ব্যাধি, অতীত শত্রুতা ও বিভিন্ন সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে ৩৬ জন নিহত হয়েছেন।এমএএফ জানাচ্ছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। গত বছরের শেষ পাঁচ মাসে দেশে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৯৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেপ্টেম্বরে। ওই মাসে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ২৪ জন। অক্টোবরে ২৩ জন, আগস্টে ২০, নভেম্বর ১৪ ও ডিসেম্বর ১৭ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৪৮ জন।
তবে আরেক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১২৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৭ জন মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে।
আসক জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। ২০২২ সালে সারা দেশে নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৮ জন। ২০২০ সালে নিহত হয়েছিলেন ৩৫ জন, ২০১৯ সালে ৬৫ ও ২০১৮ সালে ৩৯ জন। এদিকে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন, যার মধ্যে ঢাকা বিভাগেই মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে চলতি বছরের তিন মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৩৩ জন। জানুয়ারিতে ১২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৮ জন ও মার্চে ১৩ জন গণপিটুনিতে মারা গেছে। এই সময়ে আহত হয়েছে ৯৩ জন। মার্চে ৩৯টি ঘটনায় হতাহত ৬৯ জন। যার মধ্যে নিহত ১৩ ও আহত ৫৬।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ ১০ বছরে দেশে অন্তত ১ হাজার ৯টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ৭৯২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কমপক্ষে ৭৬৫ জন। সরকার পরিবর্তনের পর গত সাত মাসে (আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি) ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন এবং আহত হয়েছেন আরো ৭৪ জন। সংস্থাটি বলছে, গত বছরই গণপিটুনির ঘটনায় দেশে কমপক্ষে ১৭৯ জন মারা গেছেন।
মানবাধিকার কর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপিটুনির ঘটনায় যথাযথ আইন প্রয়োগ না হওয়ায় এ অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। পাশাপাশি এসব ঘটনা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুর চিত্রকে তুলে ধরে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. সৈয়দা আনজু বলেন, ‘নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট সাজা আছে। কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় তুলে দিতে হবে। পিটিয়ে মেরে ফেলার বিধান তো কেউ দেয়নি। কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নির্দোষ। সুতরাং অভিযোগ ওঠা মানেই তিনি অপরাধী নন।’
এ অধ্যাপক আরো বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলেও তার আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আদালতও তাকে সুযোগ দেন নিজেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার কিংবা তার অভিযোগ ডিফেন্ড করার। তাহলে অভিযোগের ভিত্তিতে যাকে হত্যা করা হলো তিনি তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কোনো সুযোগ পেলেন না। অনেক সময় প্রমাণও হয় হত্যার শিকার ব্যক্তিটি অপরাধী ছিলেন না।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘দেশে একটা অস্থিরতা চলছে। এটার সুযোগ নিয়ে অনেকে ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করছে। পূর্বশত্রুতার জেরেও এসব হত্যাকাণ্ড চলছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কঠোর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আমরা দেখেছি, ফ্যাসিবাদ খোঁজার নামে মানুষের বাড়িঘর ঘিরে রাখা হচ্ছে। সেখানেও হামলা হচ্ছে। এসবই দেশের আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার অবনতি নির্দেশ করে।’
গণপিটুনির বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিগত দিনে অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার হয়েছে এমন নজির নেই। দু-একটা ছাড়া এসব ঘটনার বিচার হয়নি।’ বিচারহীনতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে না পারা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বারবার গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।