উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা

ফেনী নোয়াখালী লক্ষ্মীপুরে তৎপরতা নেই পুনর্বাসনে

গত আগস্টের আকস্মিক বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এর পরই ক্ষতি হয়েছে লক্ষ্মীপুরে।

গত আগস্টের আকস্মিক বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এর পরই ক্ষতি হয়েছে লক্ষ্মীপুরে। বর্তমানে জেলাটির কয়েকটি এলাকায় এখনো বাড়ির উঠান ও গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে আছে। তবে বন্যা-পরবর্তী গৃহনির্মাণ বা পুনর্বাসনে এখনো আসেনি সরকারি কোনো বরাদ্দ। যতটুকু চলছে সবই বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে।

প্রবল বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ১৯ আগস্ট রাতে ডুবতে শুরু করে ফেনীর উত্তরাঞ্চল। ধীরে ধীরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয় সম্পূর্ণ ফেনী জেলা। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যার ক্ষত এখনো স্পষ্ট ফেনীর কৃষি, ঘরবাড়িসহ নানা অবকাঠামোয়। সরকারি হিসাবে বন্যায় ফেনীতে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। এছাড়া ১১ লাখের অধিক মানুষ এবং ৯৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল। বন্যাদুর্গতদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২ হাজার ৩০০ টন চাল, ৮২ লাখ টাকা, ছয় হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং শিশুখাদ্যের জন্য ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের মতামত অনুযায়ী বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে বেসরকারি উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ঘর সংস্কার, পুনর্নির্মাণে সরকারি সহায়তা এখনো দৃশ্যমান নয়। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ফেনীতে ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচা ঘর, ২৫০টি আধাপাকা ঘর বন্যায় সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচা ঘর ও ২ হাজার ৬৩২টি আধাপাকা ঘরের আংশিক ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৩৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৬৪ হাজার ৪১৫টি ঘরবাড়িতে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যা-পরবর্তী সময় বিভিন্ন বিভাগওয়ারি ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে সে আলোকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রণোদনা সহায়তা আসতে শুরু করেছে। সেগুলোর বিতরণ কার্যক্রম এখন চলমান। এছাড়া গৃহনির্মাণের জন্য সরকারি বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কাজ শুরু করে দেব। তবে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিনসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ ও গৃহনির্মাণে কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক অনুদান দিচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও ব্রিজ সংস্কারে এলজিইডি ও রোডস থেকে কিছু প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সেগুলোর কাজ করা হবে। তাছাড়া সড়কের ছোট সংস্কারগুলো স্থানীয়ভাবে করা হচ্ছে।’

দেশের দক্ষিণের ১১ জেলায় আগস্টের বন্যা অন্তত ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ক্ষতির ওই অংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। বন্যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে নোয়াখালী জেলাকে। সেখানে ক্ষতির অংক ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা মোট ক্ষতির ২৯ শতাংশ। তবে এখনো শুরু হয়নি পুনর্বাসন কার্যক্রম।

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেহেতু এখন পর্যন্ত পুরোপুরি জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি, সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তালিকা নিশ্চিত করতে আরো সময় লাগবে। এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জন্য আলাদা ১৪ কোটি ও সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। সেগুলো বিতরণে কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া সব বিভাগের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার পর নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠানো হবে। বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে পুনর্বাসনে কাজ শুরু করবে দপ্তরগুলো।’

লক্ষ্মীপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে এখনো পানি জমে আছে। সরজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার বাঙাখাঁ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা, দিঘলী ইউনিয়নের পূর্ব দিঘলী ও পশ্চিম দিঘলী গ্রামে ওয়াপদা বেড়ি-সংলগ্ন এলাকায় গ্রামীণ রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে আছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে অনেকের ঘর। প্রায় দুই মাস ধরে ওই এলাকার মানুষ পানিবন্দি। কেউ খোঁজ নেয় না বলে অভিযোগ তাদের।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া জানান, বন্যায় জেলার ৪০ হাজার ৮০১টি কাঁচা ও পাকা ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৩৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বরাদ্দ সাপেক্ষে অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় জেলায় বহুমাত্রিক ক্ষতি হয়েছে। মানুষের ঘরবাড়ির ক্ষতির পাশাপাশি কৃষি, মৎস্য এবং রাস্তাঘাট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন হিসেবে স্থানীয়দের ঢেউটিনসহ আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে ক্ষতির তুলনায় এ সহায়তা অপর্যাপ্ত। তাই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে এরই মধ্যে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর বরাদ্দ পেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে।’

আরও