ড. নিয়াজ আহমদ খান

দলান্ধ রাজনীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে

উচ্চ শিক্ষার সমস্যাগুলো মোটা দাগে সবারই জানা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মানসম্মত গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। দেশের দলান্ধ ও হিংস্র রাজনীতি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে উচ্চ

উচ্চ শিক্ষার সমস্যাগুলো মোটা দাগে সবারই জানা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মানসম্মত গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। দেশের দলান্ধ ও হিংস্র রাজনীতি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমাদের দুটি দার্শনিক বিতর্ক রয়েছে। তবে এগুলোর উত্তর আমার জানা নেই। প্রথমত, কর্মসংস্থান কিংবা চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করা উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে কিনা? এ রকম একটি শক্ত বিতর্ক আছে। উচ্চ শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (ভিইটি)। কর্মসংস্থান কিংবা চাকরির ব্যবস্থা করার সঙ্গে ভিইটি সরাসরি জড়িত। এর বাইরে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষত্বের স্ফুরণ। চাকরির বাজারের সরাসরি সম্পর্ক কিংবা দায় উচ্চ শিক্ষা নেবে কিনা সেটা আমার জানা নেই। আমি কেবল বিতর্কটি উপস্থাপন করেছি।

আরেকটি বিষয় হলো, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি করা হয় সেটি অত্যন্ত সংকীর্ণ বিভাজন। উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থে মানুষ করে গড়ে তোলা, সেক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সরকারি-বেসরকারি হচ্ছে পরিচালন ব্যবস্থার একটি বিশেষায়িত রূপ। এক্ষেত্রে শুধু পরিচালন পরিচয়ের পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য এবং পদ্ধতিতে সরকারি-বেসরকারির আলাদা কোনো বিভাজন থাকার কারণ নেই।

উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রেগুলেশনের বিষয়ে বলা দরকার। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বিষয়টি সবার আলোচনায় উঠে এসেছে। সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে এ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা কখনই কাটানো সম্ভব নয়। সরকার ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষায় পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ ব্যবস্থা করা তাদের কারো পক্ষে কোনো আমলেই বা কোনো দিনই সম্ভব নয়। উচ্চ শিক্ষায় সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সমাজকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। উচ্চ শিক্ষায় সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রধান উপায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কিংবা একাডেমিক প্র্যাকটিসিং কোলাবোরেশন। সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উচ্চ শিক্ষায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা করা কঠিন। সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়বে তত দল বা সরকার তোষণের কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবার অপরাজনীতির সুযোগ তৈরি হবে।

বর্তমানে দেশের উচ্চ শিক্ষা কী অবস্থায় আছে তা মোটা দাগে সবারই জানা। তবে নিখুঁতভাবে কেউ জানেন না। কারণ উচ্চ শিক্ষায় বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান থাকলেও তার নিখুঁত কোনো পরিসংখ্যান নেই। যেমন উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার জানতে চাইলে তিন-চারটি পরিসংখ্যানের কথা বলা হবে। আবার এ ধরনের পরিসংখ্যানে নানা ধরনের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। একটা পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, প্রতি বছর ২২ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হচ্ছে ১ লাখ ৬০ হাজার, যাতে ইন্টার্নশিপকেও চাকরি হিসেবে ধরা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উচ্চ শিক্ষা ঠিক কী পর্যায়ে আছে তা সবার জানা উচিত। এ সমস্যাগুলোর বর্তমান অবস্থা কী তা বোঝার জন্য একটি শ্বেতপত্র খুবই দরকার। সমস্যাগুলোর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সঠিক পরিসংখ্যান অবশ্যই দরকার।

দেশের উচ্চ শিক্ষায় একটি কমিশন দরকার। বর্তমানে ইউজিসি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বহুমুখী কাজ করছে। এটি এখন কেবল মঞ্জুরী কমিশন নয়। বৃহৎভাবে যদি বলি, তাহলে এটিই একটি কমিশন হতে পারে। আবার ইউজিসির কিছু অস্পষ্টতা আছে। যেমন ইউজিসির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক কী, সে প্রশ্নের মীমাংসা আগে হওয়া দরকার। ইউজিসি যদি রেগুলেশন করে তাহলে ফ্যাসিলিটেশন করে করবে? উচ্চ শিক্ষায় ইউজিসি যদি ফ্যাসিলিটেশন করে তাহলে সেটিই গুরুত্ব দেয়া উচিত। যেহেতু দেশে বর্তমানে একটি সরকারের উপযুক্ত কাঠামো আছে, তাই এ মুহূর্তে ইউজিসিতে কিছু পরিবর্তনের সূচনা করা দরকার। কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষা পদ্ধতি, গবেষণা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সিলেবাসকে বাজারমুখীকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে করপোরেট জগতের যোগাযোগ স্থাপনসহ সামগ্রিক বিষয়গুলোর কেন্দ্রীয় সমন্বয় ও ফ্যাসিলিটেশনের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। এ প্রতিষ্ঠান নতুন করেও করা যেতে পারে বা ইউজিসিকেও ঢেলে সাজানো যেতে পারে। অবশ্য নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি সময়সাপেক্ষ। তাই ইউজিসিকে ঢেলে সাজানো গেলে পরিবর্তনের সূচনা হবে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইউজিসির কী সম্পর্ক হবে তা আগেই ঠিক করে নেয়া জরুরি।

বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার আছে কিনা তা নিয়ে আমাদের এখনই ভাবা দরকার। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় উচ্চ শিক্ষার মান ধরে রাখা যাচ্ছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অনেক ভালো পারফরম্যান্স করছে। আবার কিছু অনেক পেছনে পড়ে যাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষায় ভালো প্রতিষ্ঠান আসতে পারে। একই সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠানের মান যাতে একদম নিচে নেমে না যায়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। উচ্চ শিক্ষার জন্য এরই মধ্যে যে সংখ্যক প্রতিষ্ঠান হয়েছে তা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এবং কিছু প্রতিষ্ঠানকে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এভাবে পর্যায়ক্রমে করতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

বৈশ্বিক র‍্যাংকিং নিয়ে কিছু বলা যায়। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এখনো ভালো গবেষক আছেন। কিন্তু সমস্যা হলো র‍্যাংকিংয়ের জন্য আমরা তাদের পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। একই সঙ্গে আমরা পাবলিক রিলেশনের ক্ষেত্রে (পিআর) অত্যন্ত দুর্বল। আমাদের ওয়েবসাইটগুলোর হালনাগাদ হয় না। আমরা যতটুকু কাজ করি, সেটুকুও বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে পারছি না। এ কারণে আমরা বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছি।

আবার বৈশ্বিক কিছু অসুবিধা রয়েছে। আপনি কোন ‘মানদণ্ডে’ বৈশ্বিক বলছেন? দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মিলে একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যই। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি কী এটা বিরাট অবদান নয়? হতদরিদ্র অবস্থায়ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে না? হচ্ছে। আমাদের কাছে এগুলোর জাতীয় ও সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের র‍্যাংকিং ব্যবস্থায় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে আবার অগ্রাধিকারের পার্থক্যও আছে। র‍্যাংকিং নিয়ে আমি কোনো অজুহাত দিতে চাচ্ছি না। আমাদের র‍্যাংকিং দরকার কিন্তু এক্ষেত্রে মূলধারায় প্রতিফলিত না হলেও যে বিষয়গুলো আমাদের সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। কারণ আমাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা যায় না। আমরা যদি কিউএস র‍্যাংকিংয়ের কথাই বলি, সেখানে টেকসই উন্নয়নের দিকটি বিবেচ্য ছিল না, যা পরবর্তী সময়ে সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে। ২০২৪-এ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে অসাধ্য সাধন হয়েছে তা কী বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি না?

ড. নিয়াজ আহমদ খান: অধ্যাপক ও উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[‘‌উচ্চ শিক্ষায় বৈশ্বিক মান: বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক শিরোনামে বণিক বার্তা আয়োজিত প্রথম বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষা সম্মেলন ২০২৪ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে]

আরও