বিনামূল্যের সরকারি ইনসুলিন সরবরাহ বন্ধ

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি আরো জানায়, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি বছর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ইনসুলিন পাওয়ার কথা। যদিও নতুন করে সরকারের পক্ষ থেকে ইনসুলিন দেয়া সম্ভব হয়নি।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ষাটোর্ধ্ব কানন বেগম ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয় দরিদ্র এ নারীকে। গত বছর সরকারের তরফ থেকে বিনামূল্যে ইনসুলিন সরবরাহ শুরু হওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু সরবরাহ শুরুর পর একবারই ইনসুলিন পেয়েছিলেন কানন বেগম। উপজেলা প্রশাসনের ভাষ্য, তাদের কাছে একবারই ইনসুলিন এসেছিল। এ কারণে দ্বিতীয় দফায় আর কাউকে ইনসুলিন দেয়া যায়নি।

বেলকুচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ কে এম মোফাখখারুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে সরকার থেকে ১০০টি ইনসুলিন দেয়া হয়েছিল। পরে তা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে রোগীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তার পর থেকে আর কোনো ইনসুলিনের চালান আমাদের এখানে আসেনি। সম্প্রতি চাহিদা দেখিয়ে ইনসুলিন চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করা হয়েছে।’

এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, তার উপজেলায় ৩০-৪০ হাজার ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে। এদের বড় অংশই দরিদ্র। তাদের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে ইনসুলিনের খরচ চালিয়ে যাওয়া দুরূহ।

২০২৩ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে বিনামূল্যে ইনসুলিন দেয়ার ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর দুই সপ্তাহ পর ১৫ মার্চ গাজীপুরে একটি নার্সিং কলেজের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কমিউনিটি ক্লিনিকে যে বিনা পয়সায় ওষুধ দিই সেখানে ইনসুলিনটাও বিনা পয়সায় দিয়ে দেব। যাতে এ রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পায়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে।

ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান ও ইনসুলিন সরবরাহসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিয়ে থাকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, সরকারের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট প্রথমবারের মতো বিনামূল্যের ইনসুলিন পান। এগুলো সমিতির নিবন্ধিত সুবিধাভোগী রোগীদের মাঝে বিতরণের জন্য দেয়া হয়। সরকারের দেয়া ইনসুলিন দিয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সেবা দেয়া সম্ভব হয়।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জুন থেকে সরকারের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এ কারণে শুধু বিনামূল্যে ইনসুলিন বিতরণ নয়, পুরো কর্মসূচির কার্যক্রমই স্থবির হয়ে পড়েছে।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাবেক লাইন ডিরেক্টর রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চতুর্থ সেক্টর প্রোগ্রাম বন্ধ এবং পঞ্চম সেক্টর প্রোগ্রাম এখনো শুরু হয়নি। তাই অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিসহ সব ধরনের অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।’

তিনি জানান, এখন উন্নয়ন বাজেটের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। এ কারণেই এ বছর ইনসুলিন আনা সম্ভব নয়। পঞ্চম সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হলে আমরা আবার ইনসুলিন কিনতে পারব। তিনি বলেন, ‘সরকার রাজস্ব বাজেট থেকে অন্যান্য ওষুধ কিছু দেয়ার পরিকল্পনা করছে হয়তো। কিন্তু ইনসুলিন কিনতে তো আলাদা পয়সা লাগে।’

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি আরো জানায়, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি বছর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ইনসুলিন পাওয়ার কথা। যদিও নতুন করে সরকারের পক্ষ থেকে ইনসুলিন দেয়া সম্ভব হয়নি।

ডায়াবেটিক সমিতির পরিচালক মো. শাকিল আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের স্টকে থাকা ইনসুলিন দিয়ে আর এক মাসের মতো সেবা দেয়া সম্ভব। এরপর কীভাবে সেবা দেব জানি না। আমাদের এখানে টাইপ-১ আক্রান্ত কয়েক হাজার শিশু রয়েছে। তাদের সারা জীবনই ইনসুলিন লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করছি যেন নতুন ইনসুলিন পাওয়া যায়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডায়াবেটিক সমিতিকে ১ লাখ ৩৫ হাজার ইনসুলিন দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৯০ হাজার ছিল অ্যাক্ট্রাপিড ইনসুলিন এবং ৪৫ হাজার ছিল ইনসুলেট্রাড ইনসুলিন। সারা দেশের ৩০টির অধিক ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমে নিবন্ধিত রোগীদের বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এসব ইনসুলিন দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া তথ্যমতে, অসংক্রামক রোগে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী। আক্রান্তদের তিন-চতুর্থাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের নাগরিক।

কুমিল্লা থেকে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডায়াবেটিক রোগী মো. কামালের স্ত্রী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা তো গরিব মানুষ। ৯ দিন ধরে ঢাকার হাসপাতালে আছি। অনেক খরচ। ইনসুলিন যদি সরকার থেকে পেতাম, তাহলে উপকার হতো।’

ইনসুলিন সরবরাহের বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. নাজমুল হাসানের সঙ্গে সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তার জবাবও দেননি।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনিও ফোন ধরেননি।

আরও