দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের মধ্যে অভয়ারণ্যের প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকাও পড়েছে। শুরুতে অভয়ারণ্যে রেলপথ নির্মাণে আপত্তি জানায় বন বিভাগ। তখন রেলওয়ে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ এবং হাতি চলাচলের সুবিধার্থে ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতি তারা পুরোপুরি পূরণ করেনি। আবার বিপুল অর্থ খরচ করে এমন অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তা ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি উপযোগী নয়। হাতি চলাচলের জন্য যে আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে, সেটা সরু হওয়ায় হাতির দল ব্যবহার করতে পারে না।
২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। রামু-ঘুনধুম অংশসহ প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। পরে রামু-ঘুনধুম অংশ স্থগিত রেখে নির্মাণ ব্যয় ১২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ অর্থের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ ব্যয় হয় অভয়ারণ্যের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের শুরুতে চুনতি, ফাসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর রেলপথ নির্মাণের বিরোধিতা করে বন বিভাগ। বন্যপ্রাণীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করার আশ্বাসে ভূমি ব্যবহারের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। পরে দুই সংস্থার সঙ্গে হওয়া চুক্তি ও গেজেট অনুযায়ী দাবি মেনে নিতে বারবার তাগাদা দেয় বন বিভাগ। কিন্তু কর্ণপাত করেনি রেলওয়ের প্রকল্প বিভাগ। সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর ট্রেনের ধাক্কায় একটি হাতির মৃত্যু হয়।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয় গত ডিসেম্বরে। বর্তমানে দৈনিক তিন জোড়া ট্রেন চলছে। পুরোদমে চালু হলে ট্রেন চলবে প্রায় ২৩ জোড়া। তখন হাতিসহ বন্যপ্রাণীর ঝুঁকি আরো বাড়বে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর দিয়ে রেলপথ ও অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল হাসান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অভয়ারণ্য এলাকায় কোনোভাবেই রেলপথের মতো ভারী যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ করা উচিত হয়নি। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই ট্রেনের ধাক্কায় একটি হাতি মারা গেছে। আগামীতে এ রেলপথে ট্রেন চলাচল বাড়বে। তখন কতটা ঝুঁকি তৈরি হবে, সে বিষয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কোনো ধারণাই নেই।’
গত ১৭ অক্টোবর এ বিষয়ে রেলের প্রকল্প পরিচালককে একটি চিঠি দেয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১৯ সালের ২৩ মে জারীকৃত সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসারে প্রকল্প এলাকায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ চলাচলের স্বার্থে আন্তর্জাতিক মানের ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করতে হবে রেলওয়েকে। দুটি আন্ডারপাস নির্মাণ হলেও তা হাতি চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত প্রশস্ত নয়। এ কারণে আন্ডারপাস দিয়ে হাতি চলাচল করতে পারে না।’
চিঠিতে আরো বলা হয়, দুটি ওভারপাস নির্মাণের কথা থাকলেও হয়েছে একটি। প্রজ্ঞাপনের ৪ নম্বর শর্ত অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকায় সাউন্ড ব্যারিয়ার নির্মাণের কথা ছিল; সেটাও হয়নি। ফলে শব্দদূষণে বন্যপ্রাণীর সাধারণ বসবাস ব্যাহত হচ্ছে। অভয়ারণ্যে ট্রেন চলাচলের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও মানা হচ্ছে না।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেলওয়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। এ অবস্থায় পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বন্যপ্রাণীর জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।’