পুঁজিবাজারে টানা দরপতন

জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে

একটি দেশের পুঁজিবাজারের আকার কত বড় তা পরিমাপ করা হয় মূলত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে বাজার মূলধনের অনুপাতের মাধ্যমে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় এ অনুপাত ১০০ থেকে ২০০ শতাংশের মধ্যে থাকে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর পুঁজিবাজারের আকার জিডিপির ৫০ শতাংশ থেকে প্রায় সমান হয়। যদিও উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। পুঁজিবাজারের ক্রমাগত

একটি দেশের পুঁজিবাজারের আকার কত বড় তা পরিমাপ করা হয় মূলত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে বাজার মূলধনের অনুপাতের মাধ্যমে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় এ অনুপাত ১০০ থেকে ২০০ শতাংশের মধ্যে থাকে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর পুঁজিবাজারের আকার জিডিপির ৫০ শতাংশ থেকে প্রায় সমান হয়। যদিও উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। পুঁজিবাজারের ক্রমাগত নিম্নমুখিতার কারণে বর্তমানে দেশের জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধনের পরিমাণ নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। গত দেড় বছরে এ অনুপাত কমেছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল লেনদেন শেষে সব ইকুইটি শেয়ারের বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ২৬৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বাজার মূলধন ছিল ৩ হাজার ২৬০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর ডেট সিকিউরিটিজের (ট্রেজারি বন্ড) বাজার মূলধন ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গতকাল ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৩ কোটি ৩১ লাখ টাকায়। সে হিসাবে গতকাল জিডিপির অনুপাতে এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধন ছিল ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। যদিও ডেট সিকিউরিটিজগুলো প্রত্যক্ষভাবে পুঁজিবাজারের পণ্য না হওয়ায় বৈশ্বিকভাবে বাজার মূলধন হিসাবের সময় এগুলোর মূলধনকে বাদ দেয়া হয়। সে হিসাবে বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৮২ শতাংশে।

জিডিপির অনুপাতে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাজার মূলধন ছিল ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। সেখান থেকে এটি কমে গত বছরের জুলাইয়ে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশে নেমে আসে। সর্বশেষ গত এপ্রিল শেষে দেশের জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন নামে ১৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। সাম্প্রতিক সময়ের টানা দরপতনের কারণে বর্তমানে এ অনুপাত আরো কমে ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গত বছরের মতোই চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবসে দরপতনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশের পুঁজিবাজারের। যদিও ২০২২ সালের শুরুতে বেশ আশা জাগিয়েছিল দেশের পুঁজিবাজারের পারফরম্যান্স। তবে সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকেই উত্তপ্ত বৈশ্বিক পরিস্থিতির আঁচ লাগে দেশের পুঁজিবাজারেও। পুরো ২০২৩ সালজুড়েও ছিল হতাশাজনক পারফরম্যান্স। এ সময় পুঁজিবাজারে সূচকের ওঠানামা সীমাবদ্ধ ছিল ২০০ পয়েন্টে এবং আগের বছরের তুলনায় দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে ফ্লোর প্রাইস (শেয়ারদরের নিম্নসীমা) আরোপ হলে বাজারে থাকা শেয়ারের বড় একটি অংশই লেনদেন হয়নি এবং এতে তারল্য প্রবাহ কমে যায়। এ সময় ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন ছিল মোট বাজার মূলধনের (ডেট সিকিউরিটিজ বাদে) প্রায় ৬০ শতাংশ।

এ বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। সে প্রত্যাশার ওপর ভর করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বড় দরপতনের শঙ্কা থাকলেও শুরুর ধাক্কা সামাল দিয়ে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছিল। যদিও সেটি খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই নিম্নমুখী হতে শুরু করে পুঁজিবাজার, যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। পুঁজিবাজারের এ নিম্নমুখিতার কারণে ক্রমান্বয়ে কমছে জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধনের অনুপাতও।

জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার ড. এটিএম তারিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজার মূলধন সিকিউরিটিজের মূল্য ও লেনদেনের ওপর নির্ভর করে। বেশকিছু সময় ধরে পুঁজিবাজারে শেয়ারের দাম ও লেনদেন কমছে। ফলে বাজার মূলধনও কমে গেছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণেও বাজার মূলধন কমেছে। তবে এখন যেহেতু ফ্লোর প্রাইস আর নেই তাই ধীরে ধীরে বাজার মূলধন বাড়বে বলে আশা করছি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সরকারি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তার এ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকব। এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে বাজার মূলধন অনেক বেড়ে যাবে।’

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতায় লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত আট মাসে সুদহার বাড়ানোর পর সম্প্রতি তা বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আমানতের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রবিশেষে দুই অংকের সুদও মিলছে। তাছাড়া সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নিশ্চিত মুনাফার কারণে আমানত ও সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের দিকে ঝুঁকছে। বিশ্বের সব দেশেই সুদহার বাড়লে পুঁজিবাজারে থেকে তহবিল মুদ্রাবাজারের দিকে ঝুঁকতে থাকে। তার ওপর ডলারের দরে অস্থিরতাও বড় প্রভাব ফেলেছে দেশের পুঁজিবাজারে। গত দুই বছরে টাকার ৩৬ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে। এ সময়ে ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে শেয়ার বিক্রির বিপরীতে প্রাপ্ত টাকাকে ডলারে রূপান্তর করার সময় আগের তুলনায় মুনাফা কমে গেছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। এ কারণে দেশে টাকার আরো অবমূল্যায়নের শঙ্কায় বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। টানা দুই অর্থবছর ধরে পোর্টফোলি বিনিয়োগ স্থিতি ঋণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়েও নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলর্ ঋণাত্মক  ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল ও নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যার কারণে বাজার মূলধন কমে গেছে। আমরা দেশের ভালো ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে পারিনি, যা বাজার মূলধন বাড়াতে সহায়ক হতো। এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বিত বাস্তবায়ন জরুরি। একই সঙ্গে তাদের প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে আসার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।’

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধনের অনুপাত ১৮৮ দশমিক ৬ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে তা ১১০ দশমিক ৪৬, সিংগাপুরে ১৫১ দশমিক ৬৩, হংকংয়ে ১ হাজার ১৩৮ দশমিক ৩৫, ভারতে ৯৮ দশমিক ৩৭ ও পাকিস্তানে ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ধারাবাহিক অবনতির কারণেও প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। এ সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফা কমে গেলেও ফ্লোর প্রাইস থাকার কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। এ কারণে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর তারা শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন। তাছাড়া অনেক বিনিয়োগকারীই মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার ব্যবসা করেন। এ কারণে শেয়ারের দাম কিছুটা কমে গেলেই তারা আতঙ্কে থাকেন। তাছাড়া মার্জিন ঋণের ক্ষেত্রে শেয়ারদর একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে গেলেই ব্রোকাররা আইনানুসারে ফোর্সড সেল করে দেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ফোর্সড সেল বেশ দেখা গেছে, যা পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করেছে। অতিসম্প্রতি আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি মুনাফার ও্পর করারোপের প্রস্তাব করা হবে এমব খবরের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়েছে। একে তো দুই বছর ধরে ফ্লোর প্রাইসের কারণে তারা আটকে ছিলেন, তেমন কোনো রিটার্ন পাননি। এ অবস্থায় মূলধনি মুনাফায় করারোপ করা হলে তাদের লোকসানে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বেশকিছু ভালো ও মৌলভিত্তির শেয়ারের দর কম ও আকর্ষণীয় অবস্থানে থাকলেও সেটি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। এর কারণ হচ্ছে এসব কোম্পানি ভালো করলেও এগুলোর শেয়ার দর কমতে থাকে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন ও নামসর্বস্ব কোম্পানির শেয়ার কয়েক গুণ বেড়ে যায় কোনো কারণ ছাড়াই। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, বাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে কিনা। তার ওপর রিজার্ভের ক্ষয়সহ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও তাদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে এগুলোর প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।

শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একদিকে প্রতি বছর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিন্তু সেভাবে নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে না। তার ওপর বিভিন্ন কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। এতে জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন কমে গেছে। ফ্লোর প্রাইস, সুদহার বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন, ফোর্সড সেল, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়া ও বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির মতো বিষয়গুলো পুঁজিবাজারে দরপতনের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অতিসম্প্রতি মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের প্রভাবে বিনিয়োগকারীরা আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা উচিত। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় বিনিয়োগ করে মুনাফা করলে তুলনামূলক কম কর ও স্বল্প সময়ের মুনাফার বিপরীতে বেশি করারোপের বিধান করা উচিত। তাহলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং হঠাৎ করে করারোপের দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।’

আরও