প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে অপরাধ সংঘটনের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা মেট্রোপলিটান এলাকায়। যদিও সেখানে পুলিশ, থানা, গাড়িসহ অন্যান্য সরঞ্জামের সরবরাহ অন্যান্য মেট্রোপলিটনের চেয়ে অনেক কম। আবার প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে অপরাধ সংঘটনের হার বিবেচনায় দেশে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ এলাকা হলো রাজধানী ঢাকা। যদিও পুলিশ সদস্য ও থানার সংখ্যা এখানেই সবচেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো বাহিনীটির সেবা কার্যক্রমের বড় একটি অংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। বিশেষায়িত অনেক ইউনিটও ঢাকাকেই কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়া থেকে সুবিধা গ্রহণের জন্যও অনেকের নজর থাকে এখানে।
দেশের নগরাঞ্চলে পুলিশের সেবার ওপর নাগরিকদের আস্থা নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা পরিচালনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ এবং ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের তিন শিক্ষক। এছাড়া দেশের নগরাঞ্চলে লোকসংখ্যার বিপরীতে সংঘটিত অপরাধের হার বিবেচনায় নেন তারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য ব্যবহার করে নগরভিত্তিক অপরাধ ও বাহিনীর সদস্য সংখ্যার মধ্যকার সংযোগ দেখানো হয়। গবেষণায় পুলিশের তথ্য থেকে পাওয়া সহিংস ও সম্পত্তিসংক্রান্তসহ সব ধরনের অপরাধকে বিশ্লেষণ করা হয়। এছাড়া পুলিশ তাদের নিয়ম অনুযায়ী অপরাধের যেসব ধরন নির্ধারণ করে; যেমন ডাকাতি, খুনসহ ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার আইন), নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদক, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা, চাঁদাবাজিসহ অপরাধের নানা বিভাগ-উপবিভাগ খতিয়ে দেখা হয়।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, নৃশংস অপরাধ সবচেয়ে বেশি সিলেট শহরে। সেখানে প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীর বিপরীতে নৃশংস অপরাধের হার ২ দশমিক ১৬। এদিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খুলনা শহর। সেখানে প্রতি লাখে নৃশংস অপরাধের হার দশমিক ৯৪। রংপুরে এ হার দশমিক ৪৭। নৃশংস অপরাধের হার সবচেয়ে কম ঢাকায়। এখানে প্রতি লাখে নৃশংস অপরাধের হার দশমিক ২২।
আবার জমিজমাসংক্রান্ত অপরাধ সবচেয়ে বেশি খুলনায়। শহরটিতে এ ধরনের অপরাধের আনুপাতিক হার ৩২ দশমিক ৬২। রংপুরে ২৮, সিলেটে ১৩ দশমিক ২৪ এবং সবচেয়ে কম ঢাকায় ৯ দশমিক ৩৫।
সার্বিক অপরাধ বিবেচনায়ও ঢাকার অবস্থান সবার নিচে। সবার ওপরে রয়েছে খুলনা শহর। সেখানে সার্বিক অপরাধের আনুপাতিক হার ৩৩ দশমিক ৩৭। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রংপুরে ২৮ দশমিক ৪৭, সিলেটে ১৫ দশমিক ৪০ আর সবচেয়ে কম ঢাকায় সার্বিক অপরাধের আনুপাতিক হার ৯ দশমিক ৫৮।
জরিপের তথ্য বলছে, অপরাধের আনুপাতিক হারে শীর্ষ অবস্থানকারী শহর খুলনা মেট্রোপলিটনে নয়টি থানার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে পুলিশ। আর নৃশংস অপরাধে আনুপাতিক হারে সবার ওপরে অবস্থান করা নগর সিলেটে ছয়টি থানার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে পুলিশ। আর এ তালিকায় সবার নিচে থাকা ঢাকা শহরে বর্তমানে ৫০টি থানার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পুলিশ। সবচেয়ে কম অপরাধের শহর ঢাকার থানাগুলোয় দায়িত্ব পালন করছেন ২৬ হাজার ৬৬১ জন পুলিশ কর্মকর্তা। অথচ সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ খুলনা শহরের থানাগুলোয় দায়িত্ব পালন করছেন ৪ হাজার ১০১ পুলিশ অফিসার। আর রংপুরে ১ হাজার ১৮৫ এবং সিলেটে ৩ হাজার ৩৩২ জন পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন।
সার্বিক অপরাধের আনুপাতিক হারে সবার ওপরে থাকা শহরগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছে ঢাকার থানাগুলোয়। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অর্থের লেনদেনকে ঘিরে ঢাকা হয়ে উঠেছে পুলিশের মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকায় একদিকে যেমন আনুপাতিক হারে অপরাধ কম, তেমনই আবার দ্রুত অর্থ তৈরির সুযোগও পুলিশ কর্মকর্তাদের ঢাকামুখী হওয়ার বড় কারণ। পাশাপাশি রাজধানী হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতারও কেন্দ্রবিন্দু। বিষয়গুলো পুলিশ সদস্যদের ঢাকামুখী হতে বেশি উৎসাহিত করে তোলে। এছাড়া উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও পুলিশ সদস্যদের ঢাকামুখী হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশসহ সব সরকারি কর্মকর্তার ঢাকামুখী হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং ক্ষমতাবানদের নেক নজরে থাকার মধ্য দিয়ে দ্রুত অবৈধ অর্থ তৈরির সুযোগ পাওয়া। এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনযাপনের মান বিবেচনায় নিয়েও পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তারা ঢাকামুখী হতে চান। আবার পুলিশের প্রধান সেবা কার্যক্রমগুলোও এখন ঢাকাকেন্দ্রিক। জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে হলে এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ঢাকাকেন্দ্রিক কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
পুলিশ সদস্য মঞ্জুরির ক্ষেত্রে বেশকিছু মাণদণ্ড অনুসরণ করা হয় বলে জানায় পুলিশ সদর দপ্তর। বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নগর, মহানগর বা জেলায় পুলিশ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে বেশকিছু মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। যেমন ধরেন ওই জেলার বা নগরের জনসংখ্যার অনুপাত, অপরাধের ধরনসহ বেশকিছু বিষয় রয়েছে। আর ঢাকায় পুলিশ সদস্য এবং থানার সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে জনসংখ্যার অনুপাতের পাশাপাশি দূতাবাস, এনজিওসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের উপস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতেও পুলিশ দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে। ঢাকা প্রশাসনিক শহর। দেশের প্রায় সব ধরনের প্রশাসনিক কাজ এখান থেকে হয়ে থাকে। তাছাড়া ঢাকায় বেশি পুলিশ এবং থানা স্থাপনা থাকার কারণেই হয়তো এখানে অপরাধের আনুপাতিক হার কম। তবে বাংলাদেশ পুলিশ শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।’